চাকাটা কি ঘুরছে? খুব আস্তে আস্তে হলেও?
উত্তরটা বোধহয়, হ্যাঁ। ‘না’ হলে বৃহস্পতিবার সকালে বলরামপুর থানা চত্বরে এঁকেবেঁকে থাকা দীর্ঘ সর্পিল লাইনের দিকে তাকিয়ে এক পুলিশ অফিসারের মুখ থেকে ‘‘বাব্বা, এখনই এত লোক!’’ অভিব্যক্তিটা বেরোতো না।
মাওবাদী-হুমকি উপেক্ষা করেই এ দিন জঙ্গলমহলের তিন জেলার মোট ২৮টি থানায় পুলিশের চাকরিতে যোগ দেওয়ার জন্য যে-ভাবে সাড়া পড়েছে, তাতে পুলিশ অফিসারের ওই উক্তি এতটুকু বাড়াবাড়ি নয়। এবং শুধুই কি যুবক-তরুণেরা? লাইনে তাঁদের সঙ্গে ঠায় দাঁড়িয়ে চাকরিপ্রত্যাশী কয়েকশো তরুণীও। বলরামপুর থানার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এমনই এক তরুণী সাফ বলে দিলেন, “হুমকি বড়, না পেটের টান? ঘরে চাল নেই। জমি নেই। খাবার জোটে না। বাবা মরেছেন বহুকাল হল। এমনিতেই তো বেঁচে মরে আছি! তার চেয়ে পুলিশের চাকরি করে মরা
ঢের ভাল!” |
মেদিনীপুর থানার সামনে। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল |
এই সে দিন পর্যন্ত পুলিশ-বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ার মাওবাদী উপদ্রুত জঙ্গলমহলে পাঁচ হাজার জুনিয়র কনস্টেবল নিয়োগের জন্য আবেদনপত্র বিলি শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার থেকে। প্রথম দিনই যা সাড়া মিলেছে, তাতে রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা উৎসাহিত হতেই পারেন। এই ‘উৎসাহ’ আরও তাৎপর্যপূর্ণ কেন না, মাওবাদীরা পুলিশে নিয়োগের এই সরকারি উদ্যোগের সরাসরি বিরোধিতা করছে। গ্রামে-গ্রামে মিটিং করে, পোস্টার সাঁটিয়ে ফর্ম না তোলার ‘ফতোয়া’ দিয়েছে তারা। তার পরেও জঙ্গলমহলের তরুণ-তরুণীদের পুলিশে চাকরিতে আগ্রহ মাওবাদীদের ‘সন্ত্রাসের রাজনীতি’র বিরুদ্ধে ‘রায়’ হিসেবেই দেখছেন প্রশাসনিক কর্তারা।
সাধে কী আর বাঁকুড়া জেলা পুলিশ সুপার প্রণব কুমার বলে ফেললেন, “মাওবাদীদের হুমকি উপেক্ষা করে জঙ্গলমহলের ছেলেমেয়েরা এ দিন ফর্ম তুলেছেন। শান্তি স্থাপনের জন্য পুলিশের ভূমিকায় কাজ করতে ওরাও ইচ্ছুক।” এক দিনেই তিন জেলা মিলিয়ে ১২ হাজার আবেদনপত্র বিলি হয়েছে। এর আগে হোমগার্ড এবং এনভিএফের পাঁচ হাজার পদের জন্যেও এই ২৮টি থানা এলাকা মিলিয়ে মোট ৪১ হাজার আবেদনপত্র জমা পড়েছে।
চাকাটা কি ঘুরছে? দেখিয়েছিল এ বছর ২৪ অগস্টও। জঙ্গলমহলে ২৪ ঘণ্টা বন্ধের ডাক দিয়েছিল জনগণের কমিটি। রাস্তায় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেমে সে বন্ধ কার্যত ব্যর্থ করে দিয়েছিল আম-জনতা। বাসে ভিড়, বাজারে ভিড়। স্টেশনেও যাত্রী প্রচুর। খোলা স্কুল-কলেজ, সরকারি দফতর, দোকানপাট, হাট-বাজার। হয়নি হিংসা। খাতড়া থেকে বলরামপুর, নয়াগ্রাম থেকে শালবনিসে দিন এমনই এক অচেনা বন্ধ দেখেছিল জঙ্গলমহল। |
একই দৃশ্য বলরামপুর থানায়। সুজিত মাহাতোর তোলা ছবি। |
সেই বন্ধেই কেন বন্ধ রাখা হয়েছিল স্কুল, এ প্রশ্ন তুলে পর দিন বাঁকুড়ার রানিবাঁধের হলুদকানালি এসসি হাইস্কুলে তালা মেরেছিলেন অভিভাবক ও পড়ুয়ারা। তাঁদের ক্ষোভ ছিল, ব্লকের বাকি স্কুলগুলি খোলা থাকলে এই স্কুল কেন থাকবে না।
মাওবাদী-জনগণের কমিটির নাগাড়ে বন্ধ-অবরোধের রাজনীতিতে যে মানুষের পিঠ যে দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে, বোঝা গিয়েছিল সেই নীরব প্রতিবাদেই। বোঝা গিয়েছে, যখন মাওবাদীদের ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসাবে পরিচিত পুরুলিয়ার আদিবাসী মূলবাসী জনগণের কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শম্ভু সিংহ সর্দার-সহ ৩ সদস্য প্রকাশ্য সভায় গ্রামবাসীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। বলেছেন, মাওবাদীদের সঙ্গে আর সংস্রব রাখবেন না। উন্নয়নে শরিক হবেন।
বোঝা গিয়েছিল ১৫ অক্টোবরও। ঝাড়গ্রামের তৃণমূলকর্মী রবীন্দ্রনাথ মিশ্র ও লালমোহন মাহাতোকে নৃশংস খুনের স্মৃতি তখনও টাটকা। তাজা ঝাড়খণ্ড আন্দোলন সমন্বয় মঞ্চের নেতা রবীন্দ্রনাথ ওরফে বাবু বসুর হত্যাকাণ্ডও। মাওবাদী-রাজ্য সরকার সংঘাত চরমে। জঙ্গলমহলে শান্তি ফেরানোর চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়ামে সভা করলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে হাজির কাতারে কাতারে পুরুষ-মহিলা। প্রকাশ্য মঞ্চে মাওবাদীদের সাত দিনের সময়সীমা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। হাততালিতে ফেটে পড়ল জনতা। বুঝিয়ে দিল, তারা মুখ্যমন্ত্রীর পাশেই আছে।
চাকা যে ঘুরছে, মাওবাদী ‘ঘাঁটি’ ঝাড়গ্রামের সেই স্বতঃস্ফূর্ত হাততালি দেখে কি বোঝা যায়নি সে দিনও?
এ দিনের পুলিশে চাকরির ফর্ম তোলার লাইন সেই প্রতিবাদেরই ইঙ্গিতবাহী। বলরামপুর থানা চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা ক্ষুদিরাম সিং ভূমিজ, হারাধন সিং সর্দার বলেন, “বাড়িতে তেমন রোজগার নেই। চাষবাস হয় না। পেটের দায়ে আবেদনপত্র তুলতে এসেছি।” তরুণী জ্যোৎস্না দে, রাসমনি টুডুদেরও কথায়, “ভরপেট খাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্যেই চাকরির খুব দরকার।” একই ছবি বাঁকুড়ায়। আবেদনপত্র তুলতে বারিকুল থানায় হাজির হন হিজলি গ্রামের প্রভাবতী মুর্মু, চুরকু গ্রামের রাজীবলোচন বেসরা। তাঁরা বললেন, “চাকরির খুব দরকার। সরকার আমাদের জন্য এই বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে। চাকরির আশাতেই আবেদনপত্র তুলতে এসেছি।” সারেঙ্গা থানায় অপেক্ষায় থাকা সুলতা বাস্কে, সুমিত্রা বাস্কেদের বক্তব্য, “চাকরিটা হলে পরিবারের দারিদ্র অনেকটাই মিটবে।”
প্রতিটি থানাতেই দেখা গিয়েছে, পুলিশকর্মীরা চাকরিপ্রার্থীদের ফর্ম পূরণে সাহায্য করছেন। দেখে মনে হতেই পারে, পুলিশ ও জঙ্গলমহলের তরুণ সমাজ যেন পরস্পরের অনেকটাই কাছে এসে গিয়েছে। সত্যিই কি? হাওয়া যে কিছুটা হলেও ঘুরছে, বুঝেছে মাওবাদীরাও। নিজেদের এত দিনের ‘শক্ত ভিতে’ তরুণ-তরুণীরাই যদি দলে দলে পুলিশের চাকরিতে নাম লেখায়, আশঙ্কা তো হবেই! সে জন্যই বোধহয় মাওবাদী রাজ্য কমিটির তরফে আকাশের নামে জারি করা এক বিবৃতিতে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে রাজ্য প্রশাসন (আরও নির্দিষ্ট করে বললে মুখ্যমন্ত্রীকে)। তারা যে সরকারের সঙ্গে সংঘাতে রাস্তায় যাবেন, বিবৃতিতে তা-ও স্পষ্ট। প্রশাসনকে চাপে রাখতেই কাল, শনিবার জঙ্গলমহলে বন্ধ ডেকেছে তারা। ঘটনাচক্রে সে দিনই মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া সময়সীমাও শেষ হচ্ছে।
জঙ্গলমহল সে দিনও ঘুরে দাঁড়াবে, না কি অশান্তির ভয়ে কুঁকড়ে থাকবে ঘরেই, চাকা কতটা ঘুরছে, নির্ভর করবে তার উপরেও। |