২০০৮ সালের ঘটনা। ঘনিষ্ঠ বন্ধু গোপাল দাসের স্ত্রী উমা দাসকে নিয়ে গোপালের কাছে কুপ্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ ওঠে কলকাতা পুলিশের সাউথ ট্রাফিক গার্ডের কনস্টেবল সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে ভজার বিরুদ্ধে। সুদীপবাবু বন্ধু গোপালকে খুনের চেষ্টা করেছেন বলেও অভিযোগ ওঠে। গোপাল ও উমা মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ দায়ের করেন সেই বছরই। কিন্তু সুদীপবাবুর বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ জানাতে কমিশন সময় নেয় তিন-তিনটে বছর! আরও দু’বছর স্বরাষ্ট্র দফতর নেয় সেই সুপারিশ কার্যকর করতে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাথরপ্রতিমার বনশ্যামনগর গ্রামে ২০১০-এর এপ্রিল মাসের ঘটনা। পনেরো বছরের এক কিশোরীকে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, থানার এক সাব-ইনস্পেক্টর এবং এক অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইনস্পেক্টর অভিযুক্তদের আড়াল করছেন বলে মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ জানায় সেই কিশোরী। কমিশনের সুপারিশ দিতে দু’বছর গড়ায়। অবশেষে ২০১২ সালের অক্টোবরে কমিশন তার সুপারিশে তিন পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে বলে। স্বরাষ্ট্র দফতর সেই সুপারিশ এখনও কার্যকর করেনি।
রাজ্য মানবাধিকার কমিশনে এ রকম দীর্ঘায়িত বিচার প্রক্রিয়ার এগুলো নমুনামাত্র। কমিশনে অভিযোগ জানিয়ে বিচারের অপেক্ষায় বসে থেকে বহু মানুষ অবসাদে তলিয়ে গিয়েছেন, অভিযুক্তদের হাতে হেনস্থা হয়েছেন এমন বহু অভিযোগও উঠে এসেছে। স্বভাবত প্রশ্ন উঠেছে, ‘প্রলম্বিত বিচার তো বিচার না পাওয়ারই সামিল’, সে ক্ষেত্রে মানবাধিকার কমিশন কেন সময়মতো তার সুপারিশ দিতে পারছে না? মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাজা যদি হাতে-নাতে না পাওয়া যায়, তা হলে এমন কমিশনের থেকে লাভ কী?
রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান অশোক গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য মনে করেন, গত এক বছরে দীর্ঘায়িত বিচারের সমস্যা অনেকটা কমানো হয়েছে। তাঁর কথায়, “কোনও সরকারই আসলে চায় না মানবাধিকার কমিশন শক্তিশালী হোক। তারা চায়, কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে খাতায়-কলমে থেকে যাক। তাই হয়তো কোনও কালেই একে কার্যকর করার চেষ্টা হয়নি।” চেয়ারম্যানের আরও বক্তব্য, “লোকের অভাব, কর্মসংস্কৃতির অভাব তো আছেই, সেই সঙ্গে আছে অতিরিক্ত ছুটি। কোর্টে যত দিন ছুটি, কমিশনেও তাই! এতে তো তদন্ত প্রক্রিয়ায় অযথা দেরি হয়। কিন্তু কিছুতেই এটা পরিবর্তন করা যাচ্ছে না।”
মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান তথা বর্তমান সদস্য নারায়ণচন্দ্র শীল আবার ভিন্ন মতপন্থী। তিনি মনে করেন, তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া তাড়াহুড়োর জায়গায় ধীরেসুস্থে, বুঝেশুনে করলেই সঠিক সুপারিশ দেওয়া সম্ভব। দ্রুত সব সমাধান করতে গেলে বরং ভুল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তাঁর কথায়, “জাস্টিস হারিড ইজ জাস্টিস বেরিড অলসো। আমি হাইকোর্টে থাকাকালীন জেলার এক বিচারককে নিয়ে খুব হইচই হয়েছিল। তিনি অসম্ভব দ্রুততায় পর পর মামলায় রায় দিচ্ছিলেন। দেখা গেল, কোনও সাক্ষী অনুপস্থিত থাকলে তাঁকে ওয়ারেন্ট না-পাঠিয়েই তিনি কেসের রায় দিতেন। আমরা এই ভাবে বিচার করতে চাই না।”
আবার মানবাধিকার কমিশনের যুগ্মসচিব সুজয় হালদারের বক্তব্য, “গত দেড়-দু’বছরে তদন্ত প্রক্রিয়ায় অনেক গতি এসেছে। আমাদের কাছে অভিযোগ জমা পড়ার সংখ্যা প্রায় প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। কোনও অভিযোগ পেলে আমরা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে রিপোর্ট চাই। সেই রিপোর্ট পেতে দেরি হয়। রিপোর্ট ঠিকঠাক হয়নি মনে করলে কমিশনের লোকজন সরেজমিন দেখে। তার পরে সাক্ষীদের ডাকা, শুনানি সব কিছুতে সময় লাগে। সাক্ষী সব সময়ে আসতে চান না। একাধিক তারিখ নেন। পুলিশের লোক হলে তো বার বার ডাকতে হয়।”
কমিশনের অন্য সদস্য তথা রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব সৌরিন রায়ের বক্তব্য, সব কেসে একই রকম সময় লাগে না। তাঁর কথায়, “আমরা সুপারিশ দেওয়ার পরেও স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য বা শিক্ষার মতো দফতরগুলি তা কার্যকর করতে অনেক সময় নেয়। বিষয়টি আমরা মুখ্যসচিব ও পুলিশের ডিজিকে জানিয়েছি।” |