কোথাও পড়ে রয়েছে অষ্টধাতুর মূর্তি, কোথাও থালা-বাসন-গ্লাস কিংবা শাড়ি ভর্তি বাক্স-প্যাঁটরা। এমনকী গুলি-বন্দুক-বোমা থেকে শুরু করে মোবাইল, আইপড, ল্যাপটপ— কী নেই সেখানে!
দশ ফুট বাই বারো ফুট মাপের একটা ঘর। ভিতরে মিটমিটে আলো। তারই একপাশে চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে রয়েছেন এক পুলিশকর্মী। মালের হিসাব রাখাই তাঁর কাজ। কত মাল জমে রয়েছে জানতে চাওয়ায় এক গাল হেসে বললেন, সে হিসেব জেনে করবেন কী? লক্ষাধিক তো হবেই।
পুলিশের কথায়, এটাই হল তাদের মালখানা। এখানেই জমা করা হয় আটক বা উদ্ধার করা মালপত্র। যিনি এই মালখানা পাহারা দেন তাঁকে বলা হয় ‘মালবাবু’। পুলিশ সূত্রে খবর, এখানে জমা রাখা মালপত্রের বেশিরভাগই কোনও না কোনও সময়ে বিভিন্ন ভাবে উদ্ধার করা হয়েছে। কখনও উদ্ধার হয়েছে চোর-ডাকাত-দুষ্কৃতীদের কাছ থেকে, কখনও আবার কোনও যাত্রী খোদ ব্যাগ ভর্তি টাকা নিয়ে গাড়িতে সওয়ার হয়ে নামার সময়ে ভুলে তা গাড়িতেই ফেলে রেখে চলে গিয়েছেন। ফলে প্রাথমিক ভাবে সেগুলিও গচ্ছিত হয়েছে থানায়। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে ওই সব জিনিস পড়ে থাকায় তা নষ্ট হয়ে যায়। মুর্শিদাবাদের এসপি হুমায়ুন কবীর জানান, রাজ্যে প্রায় চারশোরও বেশি থানা আছে। অনুমান, এ ভাবেই বছরের পর বছর সেখানে বন্ধ ঘরে গড়ে লক্ষাধিক টাকার সম্পদ পড়ে থাকে। |
অলঙ্করণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য |
কী হয় এই সম্পত্তি নিয়ে? হাওড়া পুলিশের কমিশনার অজেয়মুকুন্দ রানাডে বলেন, “প্রথমত, মালখানায় জমে থাকা এই সম্পত্তির কোনও দাবিদার আদালতের অনুমতি এবং সঠিক প্রমাণ নিয়ে হাজির হলে তাঁর সম্পত্তি তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। যে সমস্ত সম্পত্তির কোনও দাবিদার মেলে না, সেগুলি শেষমেশ জমা দেওয়া হয় ট্রেজারিতে।’’ তবে, কতদিন অতিক্রম হলে থানায় পড়ে থাকা সম্পত্তিগুলি সরকারি কাজের জন্য ট্রেজারির আওতায় আনা সম্ভব, তার কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা আইনে বেঁধে দেওয়া নেই বলে জানান তিনি।
জানা গিয়েছে, যে সমস্ত গাড়ি থানায় জমা পড়ে, প্রথমে মোটর ভেহিক্যাল্স থেকে সেগুলির রেজিস্ট্রেশন নম্বর খতিয়ে দেখা হয়। কোনও সমস্যা না থাকলে সব দিক খতিয়ে দেখে দাবিদারকে গাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তবে একই রেজিস্ট্রেশন নম্বরে যদি এক বা একাধিক গাড়ির সন্ধান মেলে বা অন্য কোনও গরমিল দেখা যায়, তাহলে পুনরায় শুরু হয় ছানবিন। রেজিস্ট্রেশন নম্বরে গরমিল পাওয়া গেলে গাড়ির ইঞ্জিন নম্বর চেক করে দেখে প্রকৃত মালিকের সন্ধান নেওয়া হয়। আর গরমিল পাওয়া গাড়ির দাবিদারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে ছানবিন সত্ত্বেও কোনও দাবিদারের সন্ধান না মিললে প্রথমে গাড়ির উপযুক্ত বিবরণ জানিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। তাতে সাড়া না মিললে দুই বা তিন বছর পরে গাড়ি নিলাম করে দেওয়া হয়। নিলামের টাকাও জমা হয় ট্রেজারিতে।
তবে আদৌ এই সম্পত্তির সঠিক নিষ্পত্তি করা হয় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পুলিশকর্মীদেরই একাংশ। লালবাজার সূত্রের খবর, এ ভাবে জমে থাকা টাকা, গয়না এবং গাড়িগুলিকে কাজে লাগানো গেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এমনটা হয় না। তা ছাড়া, মালখানায় জমে থাকা সম্পত্তির কোনও গতি করা বা সরকারি ট্রেজারিতে জমা দেওয়ার প্রস্তুতিই শুরু হয় খুব দেরিতে। যে সমস্ত গাড়িগুলি আটক করে রাখা থাকে, পুলিশকর্মীরা ঠিকঠাক কাজ না করায় দীর্ঘদিন ধরে সেগুলি বাইরেই পড়ে থাকে বলে অভিযোগ। ফলে যতদিনে গাড়ি নিলামের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়, ততদিনে ভাল দাম পাওয়ার জন্য গাড়ির আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। বাইরে পড়ে থেকে গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশগুলিও খারাপ হয়ে যায়। বেশিরভাগ সময়ে গাড়ির অর্ধেকেরও বেশি যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে যায়। বাইরের লোকের পাশাপাশি খোদ পুলিশকর্মীরাই প্রয়োজনমতো
গাড়ি থেকে সেগুলি খুলে নেন বলে অভিযোগ।
আবার কারও কারও অভিযোগ, উদ্ধার হওয়া টাকা, মূল্যবান গয়না সবই দীর্ঘদিন ধরে এই মালখানায় পড়ে থাকে। যে সব গাড়িগুলির দাবিদার নেই সেগুলি পড়ে থাকে থানার বাইরেই। আদপে বেশিরভাগটা নিলাম করাই হয় না। যদি বা করা হয় তা কম টাকায় কাউকে পাইয়ে দেওয়ার জন্যই। পরে কোনও এক সময়ে থানার নির্দিষ্ট ডাম্পিং এলাকায় সেগুলি ফেলে দেওয়া হয়। যেমন কলকাতা পুলিশের আওতায় থাকা থানাগুলির ক্ষেত্রে ‘ডাম্পিং জোন’ বিদ্যাসাগর সেতুর নীচের নির্দিষ্ট এলাকা।
আইন অনুযায়ী সোনার গয়না উদ্ধার হলে সেগুলি কোনও জহুরীকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে তার সমস্ত বিবরণ নির্দিষ্ট খাতায় লিখে রাখতে হয়। গয়নাগুলি যে প্রকৃত সোনার, তার একটি ‘সার্টিফিকেট’ দেবেন জহুরী। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহলের অনেকেরই অভিজ্ঞতা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা আদতে হয় না। অভিযোগ, গয়নাগুলি জহুরীকে দিয়ে পরীক্ষা করানো হয় না। মালখানার মালের হিসেব রাখার খাতাতেও সেগুলিকে সোনা না বলে ‘সোনার মতো দেখতে’ বলে উল্লেখ করা হয়। পরে সুযোগ বুঝে হয়তো একই রকম দেখতে নকল সোনার গয়না ওই জায়গায় রেখে দেওয়া হয়।
আইনজীবী নবকুমার ঘোষ বলেন, “বিচারবিভাগীয় তদন্তের সময় বাজেয়াপ্ত দ্রব্য আইন অনুযায়ী রাখার কথা আদালতের নির্দিষ্ট মালখানাতেই। কিন্তু আদালতে কোনও মালখানা নেই। তাই আদালতের অনুমতি নিয়ে তা রাখা হয় থানার মালখানায়।” ফলে মালগুলির ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। তিনি আরও বলেন, বাজেয়াপ্ত দ্রব্য যেমন ব্রাউন সুগার, জাল নোট ইত্যাদি আদালত নষ্ট করে দিতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু সেই নির্দেশ পালন করবে কে, বা কী ভাবে তা নষ্ট করা হবে এবং নষ্ট করে দেওয়ার পরে কাকে জানাতে হবে, সে বিষয়টি কিন্তু স্পষ্ট নয়। ফলে কোনটি কী ভাবে নষ্ট করা হচ্ছে, সেটা অনেকক্ষেত্রে ধোঁয়াশাই থেকে যায়। |