পরিস্থিতি প্রতিকূল। তাই শুরু থেকেই এ বার সার্বিক বাম ঐক্য গড়ে তোলার উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত তা হল না। কোথাও গোঁজ প্রার্থী রইল। আবার কোথাও এক শরিক দলের বিরুদ্ধে প্রার্থী থাকল অন্য শরিক দলের। প্রতীকেই। পঞ্চায়েত ভোটের আগে সংগঠনের এই অবস্থা নিয়ে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা বামফ্রন্টের অন্দরে। ফ্রন্টের এক প্রবীণ নেতার কথায়, “যাবতীয় প্রতিকূলতা-চক্রান্ত-আক্রমণ মোকাবিলা করেই আমাদের এগোতে হচ্ছে। ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রাখতে হচ্ছে। পরিস্থিতি বুঝে কাজ করতে হচ্ছে। সেখানে সার্বিক বাম ঐক্য না হওয়াটা অনভিপ্রেত।” তাঁর কথায়, “যে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা এগোচ্ছি, এমন কঠিন পরিস্থিতি আর আসবে না। তাই এই সময় সার্বিক ঐক্য গড়ে তোলা জরুরি ছিল। কিন্তু, তা হল না।”
দলীয় সূত্রে খবর, অন্তত ২৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতের আসনে সিপিআই প্রার্থীর বিরুদ্ধে গোঁজ প্রার্থী রয়েছে সিপিএমের। দলের কর্মীরাই শরিক দলের বিরুদ্ধে নির্দল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সবংয়ে রয়েছে ৭টি আসন, খড়্গপুর-১ এ ১৬টি এবং খড়্গপুর-২ এ ২টি। গোঁজ প্রার্থী রয়েছে পঞ্চায়েত সমিতির আসনেও। অন্য দিকে, অন্তত ১১টি গ্রাম পঞ্চায়েতের আসনে প্রকাশ্যে শরিকি লড়াই হতে চলেছে। যেখানে সিপিএমেরও প্রার্থী রয়েছে। আবার সিপিআইয়েরও প্রার্থী রয়েছে।
কেন এমন পরিস্থিতি? প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি। সিপিএমের জেলা সম্পাদক দীপক সরকার এবং সিপিআইয়ের জেলা সম্পাদক সন্তোষ রাণাদু’জনেই বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছেন। সিপিএমের এক জেলা নেতার বক্তব্য, “জেলা থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিছু ক্ষেত্রে নিচুতলায় মতবিরোধ রয়ে যায়। তা কাঠিয়ে ওঠা যায়নি। তাই এই পরিস্থিতি!”
পশ্চিম মেদিনীপুরে ত্রিস্তর গ্রাম পঞ্চায়েতের আসন সংখ্যা সব মিলিয়ে ৪ হাজার ৭১১। এর মধ্যে গ্রাম পঞ্চায়েতের আসন ৩ হাজার ৮৪৬টি, পঞ্চায়েত সমিতির ৭৯৮টি এবং জেলা পরিষদের ৬৭টি। ফ্রন্টের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, জেলা পরিষদের ৬৭টি আসনের মধ্যে ৬২টিতে প্রার্থী দেবে সিপিএম, ৪টিতে সিপিআই, একটিতে ফরওয়ার্ড ব্লক। পঞ্চায়েত সমিতির ৭৯৮টি আসনের মধ্যে ৭২০টিতে প্রার্থী দেবে সিপিএম, ৬৬টিতে সিপিআই, ১০টিতে ফরওয়ার্ড ব্লক, বিবিসি এবং ডিএসপি একটি করে আসনে প্রার্থী দেবে। অন্য দিকে, গ্রাম পঞ্চায়েতের ৩ হাজার ৮৪৬টি আসনের মধ্যে ৩ হাজার ৪০২টিতে প্রার্থী দেবে সিপিএম, ৩৭০টিতে সিপিআই, ৪১টিতে ফরওয়ার্ড ব্লক, ১৪টিতে আরএসপি, ৮টিতে বিবিসি, ৬টিতে এসপি এবং ৫টিতে ডিএসপি। তবে মনোনয়ন-পর্ব শুরু হতেই সব হিসেব ওলটপালট হয়ে যায়। দেখা যায়, গড়বেতা-কেশপুর-চন্দ্রকোনার মতো কিছু এলাকায় সিপিএম প্রার্থী খুঁজে পাচ্ছে না। দলের কর্মীরা নির্দল হয়েও ভোটে দাঁড়াতে চাইছেন না। ফলে, মনোনয়ন-পর্ব শেষে দেখা যায়, ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের ৪ হাজার ৭১১টি আসনের মধ্যে ১ হাজার ৭৯টি আসনে কোনও প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা হচ্ছে না। এর মধ্যে ৯৪৬টি আসন গ্রাম পঞ্চায়েতের। ১৩৩টি আসন পঞ্চায়েত সমিতির। এই সব আসনে একজনই প্রার্থী রয়েছেন, হাতে গোনা কিছু বাদে সবই তৃণমূলের। জানা গিয়েছে, গ্রাম পঞ্চায়েতে যেখানে ৩ হাজার ৪০২টি আসনে প্রার্থী দেওয়ার কথা ছিল সিপিএমের, সেখানে তারা প্রার্থী দিতে পেরেছে ১ হাজার ৯৬৩টি আসনে। অর্থাৎ, ১ হাজার ৪৩৯টি আসনে সিপিএমের প্রার্থীই নেই। বেশ কিছু আসনে অবশ্য দলীয় কর্মীরা নির্দল হয়ে দাঁড়িয়েছেন। অন্য দিকে, সিপিআইয়ের যেখানে ৩৭০টি আসনে প্রার্থী দেওয়ার কথা ছিল, সেখানে তারা প্রার্থী দিতে পেরেছে ২২১টি আসনে।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন কেন সার্বিক বাম ঐক্য হল না, তা নিয়েই ক্ষোভ দেখা দিয়েছে ফ্রন্টের অন্দরে। শুরু হয়েছে চাপানউতোর। দলীয় সূত্রে খবর, শরিকদের মধ্যে আসন ভাগাভাগির বিষয়টি দেখভাল করেছেন সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সত্যেন মাইতি। কোথাও কোন সমস্যা হলে শরিক দলের নেতারা তাঁর কাছেই সমস্যার কথা জানিয়েছেন। কখনও লিখিত ভাবে। কখনও মৌখিক ভাবে। তবু সব জট কাটিয়ে ওঠা যায়নি। জেলা সিপিএমের এক নেতা মানছেন, “পঞ্চায়েতে অন্তত শরিক দলগুলোর মধ্যে সার্বিক ঐক্য গড়ে তোলা উচিত ছিল। সংখ্যার নিরিখে ঐকমত্যে পৌঁছনো গেলেও বাস্তবে তা হল না। কেন এমন হল, তারও পর্যালোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। না-হলে এই ক্ষত কখনও সারবে না।” |