|
|
|
|
বাবা-ছেলের ভোটযুদ্ধে অভিমানের চোরাস্রোত |
নিজস্ব সংবাদদাতা • ঝাড়গ্রাম |
গতবারের হারের দুঃখ এ বার কড়ায়-গণ্ডায় মেটাতে চান বিরাশি বছরের পঞ্চানন সাউ। গোপীবল্লভপুর ১ ব্লকের শাসড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের হুমটিয়া গ্রামের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক-শিক্ষক পঞ্চাননবাবুর বর্ণময় রাজনৈতিক জীবনে কালির ছিটে লাগিয়ে দিয়েছে কি-না তাঁরই বড়ছেলে!
গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে বড় ছেলে গৌরাঙ্গের কাছে মাত্র ৮৩টি ভোটের ব্যবধানে হেরে মুষড়ে পড়েছিলেন পঞ্চাননবাবু। তাঁর অভিযোগ, “গৌরাঙ্গকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে দলে টেনেছিল সিপিএম। গতবার টাকা দিয়ে ভোটও কিনে নিয়েছিল ওরা।”
গতবার পঞ্চাননবাবু ছিলেন বিজেপির প্রার্থী। এ বার অবশ্য শাসড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের ১২ নম্বর আসনে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন তিনি। বছর ছেচল্লিশের গৌরাঙ্গ সাউ এ বারও বাবার বিপক্ষে সিপিএমের প্রার্থী। গতবার বাবার বিরুদ্ধে ভোটে জিতে সিপিএমের পঞ্চায়েত সদস্য হন গৌরাঙ্গবাবু। শাসড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্ষমতা অবশ্য দখল করেছিল তৃণমূল-জোট। এ বারও একই আসনে বাবা-ছেলের লড়াইকে ঘিরে সরগরম হুমটিয়া গ্রাম।
রাজনীতিতে বাপ-ছেলে যুযুধান দু’পক্ষ হলেও হুমটিয়া গ্রামে একই ছাদের তলায় থাকেন সকলেই। পঞ্চাননবাবুর দুই ছেলেই বিবাহিত। দুই ছেলেই চাষাবাদ করেন। নাতি-নাতনিদের নিয়ে বৃদ্ধের ভরা সংসার। বছর দু’য়েক আগে স্ত্রী মনোরমাদেবীর মৃত্যু হয়েছে। একই বাড়িতে থাকলেও গৌরাঙ্গ ও তাঁর ভাই নিত্যানন্দের হাঁড়ি আলাদা। পিতৃভক্ত নিত্যানন্দ আবার তৃণমূল সমর্থক। পঞ্চাননবাবুর জন্য অবশ্য দুই হেঁসেল থেকেই খাবার আসে। পঞ্চাননবাবুও বলেন, “পালা করে দুই পুত্রবধূই আমার সেবাযত্ন করে।”
ষাটের দশকে একটানা তেরো বছর শাসড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের কংগ্রেস প্রধান ছিলেন পঞ্চাননবাবু। পরে ’৯৮ সালে ফের ঝাড়খণ্ড সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থী হয়ে জিতে শাসড়া পঞ্চায়েতের প্রধান হন। ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে গোপীবল্লভপুর পঞ্চায়েত সমিতির নির্দল সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু ওই বছরেই গৌরাঙ্গ সিপিএমে যোগ দেন। ছেলে সিপিএমে যোগ দেওয়ায় দুঃখ পেয়েছিলেন পঞ্চাননবাবু। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে শাসড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি আসনে পঞ্চাননবাবু বিজেপির প্রার্থী হতেই সিপিএমও ওই আসনে গৌরাঙ্গকে প্রার্থী করে। বাবাকে হারিয়ে জেতেন গৌরাঙ্গ। পাঁচটা বছর ধরে পরাজয়ের যন্ত্রণা কুরে কুরে খেয়েছে অশীতিপর বৃদ্ধকে। মহাকরণে বদল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চাননবাবুও বিজেপি থেকে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। জীবনসায়াহ্নে পৌঁছনো বৃদ্ধের দাবি, “কোমরে ব্যথা। লাঠিতে ভর দিয়ে ভোটারদের বাড়িতে যাচ্ছি। মানুষ এ বার আমাকেই বেছে নেবেন। এতগুলো বছর পঞ্চায়েতের ক্ষমতায় থেকেও আমার পাকা বাড়ি হয়নি। মাটির বাড়িতে থাকি। পরিবারের কাউকে চাকরি করে দিইনি। সব সময় মানুষের পাশে থেকেছি। গৌরাঙ্গ তো পাঁচ বছর পঞ্চায়েত সদস্য থেকেও এলাকার কোনও উন্নয়ন করতে পারল না।”
গৌরাঙ্গবাবু বলেন, “শাসড়া পঞ্চায়েতের ক্ষমতায় ছিল তৃণমূল। আমি সিপিএম সদস্য হওয়ায় আমার এলাকায় উন্নয়নের জন্য কোনও অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি। জনগণ এখন অনেক সচেতন তাঁরাই যোগ্য প্রার্থী বেছে নেবেন। বাবার বিরুদ্ধে কিছু বলতে চাই না।”
তবে, বাবা-ছেলে দু’জনেই জানাচ্ছেন, রাজনীতির আকচাআকচি বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে। বাড়িতে সবাই-ই এক পরিবার। পঞ্চাননবাবুর নাতি-নাতনিদের কথায়, “ভোট এলেই ঠাকুর্দা আর বাবা-কাকাদের মুখ থমথমে হয়ে যায়।” পড়শিরাও জানাচ্ছেন, ভোট না পেরনো পর্যন্ত সাউ-বাড়িতে কেমন যেন একটা দমবন্ধ চাপা অভিমানের চোরাস্রোত বয়ে যায় দুই শিবিরেই। |
|
|
|
|
|