|
|
|
|
দলে-সরকারে বদল, দুর্গ সাজাচ্ছেন রাহুলই |
শঙ্খদীপ দাস • নয়াদিল্লি |
লোকসভা ভোটের আগে ঘর ভাঙল এনডিএ-র। আর সেই সময়েই ঘর গোছাতে নেমে পড়লেন সনিয়া ও রাহুল গাঁধী। ইন্দিরা গাঁধী জমানার কামরাজ পরিকল্পনার মতো রাতারাতি কোনও বড় পরিবর্তন না হলেও, ভোটযুদ্ধে নামার আগে সংগঠনের দায়িত্বে যথাসম্ভব যোগ্য সৈনিকদের বেছে নিতে চাইলেন মা-ছেলে। রদবদলের ধরন দেখে কংগ্রেস নেতারাই বলছেন, ছেলের মত-ই গুরুত্ব পেল বেশি। কংগ্রেসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতার পদে উত্তরণের ঠিক ছ’মাস পর রাহুল তাঁর টিম গড়লেন। যে টিমে গুরুত্বপূর্ণ সব দায়িত্বে তুলে আনা হল তুলনামূলক ভাবে নবীনদের। সেই সঙ্গে আগের তুলনায় বেশি সংখ্যক নেতাকে সাংগঠনিক দায়িত্ব দিয়ে পারদর্শিতা ও দায়বদ্ধতা সুনিশ্চিত করারও চেষ্টা করলেন রাহুল।
কংগ্রেসের সাংগঠনিক রদবদলের সঙ্গে সমন্বয় রেখে সম্ভবত কাল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাতেও রদবদল হবে। ভোটের আগে সম্ভাব্য সেই শেষ রদবদলেও রাহুল চমক দেবেন বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রে দাবি করা হচ্ছে। বিশেষ করে, রেল, বস্ত্র এবং সড়ক পরিবহণ মন্ত্রকে নতুন মুখ দেখা যাবে বলেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
মূলত দু’টি বিষয়কে মাথায় রেখে টিম সাজাচ্ছেন রাহুল। প্রথমটি হল, ৪ রাজ্যে বিধানসভা ভোট। তার জন্য একটি স্বল্পমেয়াদি কৌশল তৈরি করেছেন তিনি। এখনই গড়ে দিয়েছেন মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, রাজস্থান ও দিল্লিতে প্রার্থী বাছাইয়ের কমিটি। এর পাশাপাশি লোকসভা ভোটের কথা ভেবে একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলও নিচ্ছেন রাহুল। সে জন্য সংগঠনের পাশাপাশি মন্ত্রিসভাতেও পারদর্শী নেতাদের আনার চেষ্টা হচ্ছে।
তবে দল ও সরকারে এই রদবদলের চেয়েও আজ ঘটনাবহুল রবিসন্ধ্যায় কংগ্রেস ও বিজেপি শিবিরের বৈপরীত্যটাই আলোচনার প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে রাজধানীর রাজনীতিতে। এক দিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, বিজেপি কোনও একটা সিদ্ধান্ত নিতে হিমসিম খাচ্ছে। গোষ্ঠী-কোন্দলে দল দীর্ণ। শরিকও ধরে রাখতে পারছে না। বিপরীতে সনিয়া এবং রাহুল কিন্তু রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দেখালেন। দু’জন মন্ত্রীকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দলে আনা হল, আরও কয়েক জনকে সরানো হতে পারে কাল, কিন্তু রাগ-ক্ষোভের চিহ্নমাত্র নেই। বরং দেখা গেল, রাহুল ক্রমশ কেমন ‘টাস্ক মাস্টারের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। বাজি ধরছেন, তরুণদের ওপর।
গত কাল রাতে মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেন আবাসন ও দারিদ্র দূরীকরণ মন্ত্রী অজয় মাকেন এবং রেল ও সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী সি পি জোশী। আজ তাঁদের দু’জনকেই সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছেন রাহুল। কংগ্রেস রাজনীতিতে এঁরা দু’জনেই রাহুলের লোক বলে পরিচিত। ভোটের আগে মাকেনকে দলের প্রচারের দায়িত্ব দিলেন রাহুল। মিডিয়া বিভাগের চেয়ারম্যান পদ থেকে জনার্দন দ্বিবেদীকে সরিয়ে মাকেনকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হল। সেই সঙ্গে মিডিয়া বিভাগের নাম বদলে করা হল, যোগাযোগ ও প্রচার বিভাগ। শুধু সংবাদমাধ্যম নয়, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার চালানোরও দায়িত্ব থাকবে মাকেনের ওপর। ফেসবুক-টুইটারে মাকেন ইতিমধ্যেই সক্রিয়। তাঁর সহযোগী হিসেবে থাকবেন মুম্বইয়ের সাংসদ প্রিয়া দত্ত। অন্য দিকে সি পি জোশীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও অসমের।
মাকেন ও জোশীকে সংগঠনের দায়িত্বে আনার পিছনে অন্য কৌশলও রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। মাকেন দিল্লির ও জোশী রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার। কংগ্রেসের একটি সূত্রে বলছে, তাঁরা যাতে বিধানসভা ভোটের আগে শীলা দীক্ষিত বা অশোক গহলৌতকে বিরক্ত করতে না পারেন সে জন্যই তাঁদের কেন্দ্রীয় সংগঠনে দায়িত্ব দিয়ে বেঁধে রাখার চেষ্টা করলেন কংগ্রেসের সহসভাপতি।
দলের সাংগঠনিক রদবদলে
কালো ঘোড়ার মতো উঠে এলেন রাহুল-ঘনিষ্ঠ আর এক নেতা। তিনি গুজরাতের প্রাক্তন সাংসদ মধুসূদন মিস্ত্রী। সম্প্রতি কর্নাটক বিধানসভা ভোটে তাঁকে প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন রাহুল। দক্ষিণে সফল হওয়ার পর তাঁকে তুলে এনে দায়িত্ব দেওয়া হল উত্তরপ্রদেশের। লোকসভা ভোটে হিন্দিবলয়ের বৃহত্তম এই রাজ্যে কংগ্রেসের আসন ধরে রাখাটা এ বার সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ।
বিজেপি এই রাজ্যে আসন বাড়ানোর দায়িত্ব দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদীর সব চেয়ে আস্থাভাজন নেতা অমিত শাহকে। এ রাজ্যে এক গুজরাতিকে ঠেকাতে আর এক গুজরাতিকে দায়িত্ব দিলেন রাহুল। রাহুলের নির্দেশে মধুসূদন ইতিমধ্যেই গোটা দেশ ঘুরে লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ শুরু করে দিয়েছেন। তাঁকে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যানও করা হয়েছে আজ।
অম্বিকা সোনিকে এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক করে কংগ্রেস সভানেত্রীর দফতরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এটাও তাৎপর্যপূর্ণ। কংগ্রেসের একাংশ নেতার মতে, এ ক্ষেত্রেও রাহুলের কর্তৃত্বের ছাপ স্পষ্ট। কারণ, কংগ্রেস মহলে অভিযোগ শোনা যায় যে, সনিয়ার চার দিকে কার্যত একটা বলয় তৈরি করে রাখেন আহমেদ পটেল। সনিয়ার কাছে পৌঁছতে পারেন না অনেকেই। এই অবস্থায় এমন এক জনকে কংগ্রেস সভানেত্রীর দফতরের দায়িত্ব দেওয়া হল যাঁর সঙ্গে আহমেদ পটেলের বিশেষ সখ্য নেই। তেলেঙ্গানা অশান্তির প্রেক্ষাপটে অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটকের দায়িত্ব দেওয়া হল অভিজ্ঞ নেতা দিগ্বিজয় সিংহকে।
সাংগঠনিক রদবদলের পাশাপাশি কাল মন্ত্রিসভার রদবদলে বেশ কিছু নতুন মুখ দেখা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। কেন্দ্রে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার থেকে ডিএমকে-র সমর্থন প্রত্যাহার এবং দুর্নীতি ও অনিয়মের দায়ে রেলমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীর পদ থেকে পবনকুমার বনশল এবং অশ্বিনী কুমারকে সরানোর পর এমনিতেই মন্ত্রিসভায় ৪টি শূন্যপদ ছিল। তা ছাড়া গত কাল দুই মন্ত্রী ইস্তফা দিয়েছেন। কংগ্রেস সূত্রে বলা হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে মল্লিকার্জুন খার্গেকে রেল মন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার ছিলেন খার্গে। কিন্তু তুলনামূলক জনপ্রিয় নেতা সিদ্দারামাইয়াকে মুখ্যমন্ত্রী করার পর বর্ষীয়ান খার্গেকেও সন্তুষ্ট করতে পারেন সনিয়া-রাহুল। খার্গের হাতে থাকা তুলে দেওয়া হতে পারে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, রাজস্থানের সিসরাম ওলার হাতে। কর্নাটকে বিধানসভার পর লোকসভা ভোটেও ভাল ফল করতে চাইছে কংগ্রেস। সেই কারণে কাল এই রাজ্যের এক নেতা তথা সনিয়ার আস্থাভাজন অস্কার ফার্নান্ডেজকে মন্ত্রী করা হতে পারে। দেওয়া হতে পারে সড়ক পরিবহণ মন্ত্রক। তবে আইন মন্ত্রক সম্ভবত অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে থাকবে আইনজীবী কপিল সিব্বলের কাছেই।
এ ছাড়াও প্রতিমন্ত্রী বা স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রীর পদে মন্ত্রিসভায় নতুন মুখ হিসেবে দেখা যেতে পারে রাজস্থানের নেত্রী গিরিজা ব্যাস, রাহুল-ঘনিষ্ঠ যুব কংগ্রেস নেত্রী মীনাক্ষী নটরাজন, অন্ধ্রের নেতা জে ডি সিলম এবং হরিয়ানার নেতা বীরেন্দ্র চৌধুরিকে। উত্তরপ্রদেশ থেকে সংখ্যালঘু নেতা রশিদ আলভিকে মন্ত্রী করা হতে পারে বলেও কংগ্রেসের একটি সূত্রে দাবি করা হচ্ছে।
বিহারে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে রামবিলাস পাসোয়ানকে মন্ত্রী করা হতে পারে বলেও জল্পনা উচ্চগ্রামে। কংগ্রেসের নেতারা তার যুক্তিও দিচ্ছেন। তাঁদের কথায়, বিহারে নীতীশ কুমার বা
লালু প্রসাদ যার সঙ্গেই কংগ্রেসের জোট হোক না কেন, রামবিলাস
তাতে থাকবেন।
তবে শেষ পর্যন্ত কাল মন্ত্রিসভার রদবদলের প্রকৃত ছবি কী হবে এবং সংগঠন ও মন্ত্রিসভার রদবদল লোকসভা ভোটের আগে কতটা কার্যকরী হয়ে উঠবে তা সময়ই বলবে।
|
পুরনো খবর: মন্ত্রিসভায় রদবদলের ইঙ্গিত দিয়ে ইস্তফা দিলেন মাকেন |
|
|
|
|
|