|
|
|
|
অনেক আগেই সিদ্ধান্ত এনডিএ ছাড়ার, হিসেবি ঝুঁকি নীতীশের |
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
ঠিক তিন মাস আগের কথা। দিল্লির রামলীলা ময়দানে নীতীশ কুমারের অধিকার সভা, আর রাতে বিজেপি নেতা অরুণ জেটলির বাড়িতে ভোজ। অরুণের কৈলাশ কলোনির বাড়িতে কখন এসে পৌঁছবেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার, তার জন্য অপেক্ষা করছেন সকলে। নীতীশ আর আসেন না! নীতীশের পার্শ্বচর, বিহারের বিধান পরিষদের সদস্য বিজেপি থেকে জেডিইউ-এ চলে যাওয়া সঞ্জয় ঝা-কে ফোন করলেন জেটলি। জানা গেল নীতীশ রামলীলা ময়দান থেকে সটান চলে গিয়েছেন তাঁর বন্ধু তথা রাজ্যসভা সদস্য নন্দকিশোর সিংহের বাড়ি। সঞ্জয়কে অরুণ বললেন, “বাইপাস সার্জারির পরে চিকিৎসকেরা আমাকে রাত এগারোটার মধ্যে শুয়ে পড়তে বলছেন। তোমার মুখ্যমন্ত্রীকে বলো, খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
তারও অনেক পরে এসে পৌঁছলেন নীতীশ। অরুণকে বললেন, “কিশোরী আমনকরকে বাড়িতে ডেকেছিলেন নন্দু। এত বয়স, তা সত্ত্বেও কী গানটাই না গাইলেন! নানা দলের নেতারা সেখানে ছিলেন। প্রথম সারিতে বসিয়ে দিল, মাঝ পথে উঠে আসি কী করে?” |
|
আসলে নীতীশ তখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, এনডিএ ছাড়ছেনই। নন্দুর বাসভবনে কংগ্রেসের অনেক নেতাই উপস্থিত ছিলেন। অধিকার সভার সাফল্যের জন্য নীতীশকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলেন তাঁরা। কেউ কেউ নরেন্দ্র মোদীর প্রসঙ্গও তোলেন। তখনই নীতীশ রাখ-ঢাক না-করে বলে দিয়েছিলেন, “২০১৪-এ ওই লোকটা এনডিএ-র মুখ হলে আমি নেই!”
সে দিন নৈশ ভোজে আমিষ-নিরামিষ দু’রকম খাবারই ছিল। অরুণ নিজে অমৃতসরি মাছ আর মুরগি তৃপ্তি করে খাচ্ছিলেন। নীতীশ বললেন, “অনেক আমিষ খেয়েছি। আর খাচ্ছি না। আমাকে নিরামিষ তরকারি দাও।”
নীতীশের পথ যে বেঁকে গিয়েছে, তা অনেক আগেই টের পেয়ে গিয়েছিলেন বিজেপির তরফে বিহারের দায়িত্বপ্রাপ্ত অথচ মোদীর বন্ধু অরুণ জেটলি। এন কে সিংহ যেমন কংগ্রেসের সঙ্গে নীতীশের যোগসূত্র, নীতীশের মাঝের হাইফেনটুকু। অরুণ বলতেন, ‘কিচেন ক্যাবিনেট।’ নীতীশের কিচেন। সেই সঞ্জয় অনেক আগে অরুণকে সেই খাস-খবরটুকু দিয়ে দিয়েছিলেন নীতীশ এনডিএ ছাড়ছেনই।
আসলে নরেন্দ্র মোদী একটা রোগের উপসর্গ। রোগটা হল সংখ্যালঘু ভোট হারানোর ভয়। বিহারে ১৯৯০ সালে লালু প্রসাদ যে দিন লালকৃষ্ণ আডবাণীকে গ্রেফতার করেছিলেন, সে দিনও তাঁর লক্ষ্য কিন্তু আডবাণী ছিলেন না। হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী আডবাণীকে গ্রেফতার করে বিহারের মুসলমানদের নয়নের মণি হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন লালু। একই উদ্দেশ্যে লখনউয়ের তখ্তে বসে মুলায়ম সিংহ তখন আডবাণীকে গ্রেফতারের জন্য ছটফট করছিলেন। কিন্তু তার আগেই লালু সে কাজটি করে মুলায়মকে টেক্কা দিয়েছিলেন। আর তার পর? মুসলমান ও যাদব ভোট মিলে বিহারে তৈরি হয়েছিল নতুন অক্ষ।
দু’দশক পরে আজ সেই লালুর ভূমিকাতেই নীতীশ। আর আডবাণীর ভূমিকায় নরেন্দ্র মোদী। সময় বদলায়। কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতেই থাকে। এক বিরাট ঝুঁকি নিচ্ছেন নীতীশ। ভাবছেন, মোদী মেরুকরণের ঝড় তুললে তিনিও রাজ্যের অধিকাংশ মুসলমান ভোট তাঁর দিকে নিয়ে আসতে পারবেন। কিন্তু এর ফলে তাঁকে ঠাকুর, ভূমিহার, কায়স্থ, ব্রাহ্মণ উচ্চবর্ণের এই ভোট হারাতে হতে পারে। হিসেব কষেই কিন্তু নীতীশ এই ঝুঁকি নিচ্ছেন। কারণ তিনিও ভাবছেন লালুর যাদব ভোটের মতো কূর্মি-কৈরি ভোট-সহ অতি পিছড়ে বর্গের ভোটও তাঁর পক্ষে পড়বে, যা মোট ভোটের প্রায় ২৭-৩০ শতাংশ।
অরুণ জেটলি লন্ডনে ছুটি কাটাতে গিয়েছেন। আডবাণী-সুষমারা এখনও নীতীশকে বোঝাচ্ছেন, বিজেপি ছেড়ে যেও না। তাঁদের যুক্তি, কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে গেলে লোহিয়াপন্থী নীতীশের ক্ষতিই হবে। বিজেপিকে সঙ্গে নিয়ে বিহারের অগ্রগতির যে চেষ্টা শুরু হয়েছে, তা ব্যাহত হবে।
নীতীশ কিন্তু আর শুধু বিহারের কথা ভাবছেন না। তাঁর নিশানায় দিল্লির মসনদ। নীতীশ মনে করেন, নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে আর যাই হোক ২৭২ আসন জোগাড় করে এনডিএ-র সরকার গড়া অসম্ভব। আর এ জন্য অনেক আগেই নীতীশ বিজেপির সঙ্গত্যাগের বিষয়টি ভেবে রেখেছিলেন। ধৈর্য তাঁর অসীম। রাজ্যপাট যাওয়ার পরে লালু-রাবড়ী ১ নম্বর অ্যানে মার্গে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িটি ছাড়তে চার মাস সময় নিয়েছিলেন। নীতীশ একটুও মাথা গরম করেননি। প্রশ্ন তোলেননি, কেন এক কথায় বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন না লালু? কিছু দিন আগে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের লনে এক নিরিবিলি দুপুরে খড়ের ছাউনিতে বসে নীতীশ কুমার এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, “আপনি কি জানেন, আরএসএস এই পটনা শহরে দু’-তিন দিনের একটি সম্মেলন করছে? ওরা ভাবছে, হিন্দুত্ব করে নিজেরা বাড়বে আর আমাকে বেগ দেবে। এত সহজে আমি সাম্প্রদায়িক শক্তিকে এ রাজ্যে ঢুকতে দেব না।” আর সেই কারণে গত এক বছর ধরে নীতীশ ফেডেরাল ফ্রন্ট গড়ার উদ্দেশ্যে নিরন্তর যোগাযোগ রেখে চলেছেন নবীন পট্টনায়ক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো আঞ্চলিক নেতাদের সঙ্গে।
নীতীশের বয়স তখন অল্প ছিল। কিন্তু খুব কাছ থেকে দেখেছেন রামমনোহর লোহিয়া থেকে জয়প্রকাশ নারায়ণ, লালু প্রসাদ থেকে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহদের রাজনীতি। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তাঁর যুক্তি, “ঝুঁকি ছাড়া রাজনীতি
হয় না।” |
পুরনো খবর: নীতীশ-বিদায় অনিবার্য, চেষ্টা দরজা খুলে রাখার |
|
|
|
|
|