|
|
|
|
জোট ছাড়লেন নীতীশ, বিজেপি বলল বিশ্বাসঘাতক |
স্বপন সরকার • পটনা
দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় • নয়াদিল্লি |
শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদটা হয়েই গেল। বিজেপির সঙ্গে ১৭ বছরের জোট সম্পর্ক ভেঙে দিল নীতীশ কুমারের জেডিইউ।
গত রবিবার গোয়ায় নরেন্দ্র মোদীকে নির্বাচনী প্রচার কমিটির প্রধান ঘোষণা করে কার্যত তাঁকেই আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনে দলের মুখ ঘোষণা করেছিল বিজেপি। আর তার ঠিক সাত দিনের মাথায়, আজ, আর এক রবিবার বিজেপি-সঙ্গ ত্যাগ করে এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে এল জেডিইউ। গত ক’দিন ধরে এ নিয়ে বিস্তর টানাপোড়েনের পরে আজ পটনায় ১ অ্যানে মার্গে, মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে সরকারি ভাবে সম্পর্কচ্ছেদের কথা ঘোষণা করেন নীতীশ কুমার ও শরদ যাদব। একই সঙ্গে শরদ যাদব জানিয়ে দিলেন, এনডিএ-র আহ্বায়ক পদ থেকেও ইস্তফা দিচ্ছেন তিনি।
সতেরো বছরের সুদীর্ঘ সম্পর্কের তিক্ত পরিণতির শিকড় বিজেপিতে মোদীর উত্থানই। জোট ছাড়ার ঘোষণার সময় একবারও অবশ্য তাঁর নাম মুখে আনলেন না নীতীশ। কিন্তু ‘বিজেপির বাইরের নেতাদের হস্তক্ষেপে’র কথা বলে জেডিইউ নেতৃত্ব বুঝিয়ে দিলেন, বিজেপিতে আর অটল-আডবাণী জমানা নেই। শরদ যাদবের কথায়, “অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আডবাণীরা যে এনডিএ তৈরি করেছিলেন, এখন আর তা নেই।” রাজ্য মন্ত্রিসভা থেকে বিজেপির ১১ জন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করার সুপারিশও আজ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। নীতীশের নিশানা মোদী হলেও বিজেপির অন্য নেতাদের প্রতি কিন্তু কোনও কঠোর শব্দ ব্যবহার করেননি তিনি। এ দিন দলীয় নেতা-কর্মীদের সামনেও তিনি বলেন, “এত দিন আমরা এক সঙ্গে চলেছি। কোথাও যেন ওঁদের বিরুদ্ধে কটূ মন্তব্য না করা হয়।” কারণ নীতীশ জানেন, বিজেপির মধ্যেও মোদীকে নিয়ে যথেষ্ট বিবাদ রয়েছে। আডবাণীও আজ বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহকে ফোন করে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, গোয়ায় মোদীকে নিয়ে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যই জোট ভাঙার এই খেসারত দিতে হল। |
|
জোটটা যত দিন বিহার-কেন্দ্রিক ছিল,
কোনও অসুবিধে হয়নি। সমস্যা ডেকে আনল বাইরের হস্তক্ষেপ। নীতীশ কুমার |
বিচ্ছেদ বৃত্তান্ত |
বেলা সাড়ে ১১টা: মন্ত্রিসভার বৈঠক। বিজেপি মন্ত্রীরা গরহাজির
বেলা সাড়ে ১২টা: জোট ভাঙার সিদ্ধান্ত নিল জেডিইউ, পাল্টা বৈঠক বিজেপি-র
দুপুর ১টা: রাজনাথকে ফোন অসন্তুষ্ট আডবাণীর
দুপুর ২টো: রাজ্যপাল-নীতীশ বৈঠক। আস্থা ভোটের জন্য বিধানসভার অধিবেশন ডাকার প্রস্তাব
দুপুর ৩টে: জোট ছাড়ার ঘোষণা নীতীশ-শরদের
বিকেল ৪টে: মঙ্গলবার বিহার বন্ধ, জানালেন সুশীল মোদী
সন্ধে ৬টা ২০: দুর্ভাগ্যজনক, বললেন রাজনাথ |
গোয়ার তাড়াহুড়োটাই
বিহারের এই সঙ্কটের কারণ।
লালকৃষ্ণ আডবাণী |
দাঙ্গার জন্য মোদী দায়ী? কংগ্রেস শাসনের
সময়েও তো বড়সড় দাঙ্গা হয়েছিল।
রাজনাথ সিংহ |
আরে ভাই, দো বেমেল
পার্টনার
কা প্রেমবিবাহ টুট গয়া!
লালু প্রসাদ |
|
|
এ দিন নিজের সরকারি বাসভবনে বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ মন্ত্রী পরিষদের বৈঠক ডাকেন নীতীশ। সেখানে বিজেপির মন্ত্রীরা গরহাজির ছিলেন। যা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী পরে বলেন, “বিচিত্র পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ওঁঁরা যে আসছেন না, আমাকে তা জানাননি। আমি সংবাদমাধ্যমে জানতে পেরেছি!” যার জবাবে বিহার বিজেপির নেতা তথা উপ-মুখ্যমন্ত্রী সুশীল কুমার মোদী বলেন, “সাত বছরে কোনও দিন রবিবার ক্যাবিনেট বৈঠক ডাকা হয়নি। কাল রাত ১১টা নাগাদ মন্ত্রীদের ঘুম ভাঙিয়ে এই বৈঠকের খবর দেওয়া হয়! আজ সকাল ন’টায় আমি বৈঠকের খবর জানতে পারি! এর মানে কী? কেন ডাকা হল, জানি না। সুতরাং সেখানে আমাদের যাওয়ার কোনও অর্থ হয় না।”
আজ জেডিইউ-এর তরফে জোট ছাড়ার সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা হতেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব। নীতীশরা যে ভাবে জোট ছেড়েছেন, তার প্রতিবাদে আগামী মঙ্গলবার বিহার বন্ধের ডাক দিয়েছে বিজেপি। নীতীশের ইস্তফা চেয়ে ওই দিন রাজ্য জুড়ে ‘বিশ্বাসঘাতক দিবস’ও পালন করবে তারা। কিন্তু ইস্তফা নিয়ে বিজেপির দাবিকে পাত্তা দিতে নারাজ নীতীশ। নিজের সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে বন্ধের পরের দিন, অর্থাৎ বুধবার বিধানসভায় আস্থা ভোটের ডাক দিয়েছেন তিনি। ২৪৩ আসনের বিহার বিধানসভায় এই মুহূর্তে জেডিইউ-এর ১১৮ জন বিধায়ক রয়েছেন। আর চার জনের সমর্থন পেলেই নীতীশের সরকার বেঁচে যাবে। রাজ্যের ছ’জন নির্দল বিধায়কের মধ্যে ইতিমধ্যে পাঁচ জনই নীতীশকে সমর্থনের কথা জানিয়ে দিয়েছেন।
আডবাণী শিবির অবশ্য এখনও নীতীশের দলের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের জন্য সচেষ্ট। কিন্তু রাজনাথ শিবির মনে করছে, আডবাণীরা যতই চেষ্টা করুন, মোদীর ব্যাপারে দল আর পিছু হঠবে না। দলের অনেক নেতা আজ প্রকাশ্যে সে কথা বলেওছেন। রাজনাথ সন্ধ্যায় দিল্লিতে মোদীর পক্ষেই সওয়াল করে বলেন, “যখন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়ার সময়, তখন জেডিইউ জোট ভেঙে দিল! আমি কি নরেন্দ্র মোদীকে প্রচার কমিটির প্রধান করে কোনও অপরাধ করেছি? মোদী কি গুজরাতের দাঙ্গার জন্য দায়ী? কংগ্রেস জমানায় কি দাঙ্গা হয়নি?” শুধু তাই নয়, জোট ভাঙার কথা ঘোষণার পর বিজেপির তরফে দশ বছর আগে নীতীশের একটি বিবৃতিও আজ প্রকাশ্যে আনা হয়। গুজরাত দাঙ্গার পর ২০০৩ সালে গুজরাতের কচ্ছে রেলের একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন নীতীশ। সেখানে তিনি বলেছিলেন, “নরেন্দ্র মোদী বেশি দিন গুজরাতে সীমাবদ্ধ থাকতে পারবেন না। দেশের সেবা করার সুযোগ মিলবে তাঁর। গুজরাতে এত উন্নয়ন হলেও তাঁর নেতিবাচক ছবিই প্রচারিত হচ্ছে।” নীতীশের বিরুদ্ধে প্রচারে বিজেপি অস্ত্র করবে গুজরাত দাঙ্গার পরেও কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় তাঁর থেকে যাওয়ার বিষয়টিকেও। বিজেপি নেতারা জানেন, এটি এখনও নীতীশের দুর্বল জায়গা। আজ সাংবাদিক বৈঠকে ঠিক এই প্রশ্নের পরেই উঠে যান জেডিইউ নেতারা। উত্তরপ্রদেশে মোদী-ঘনিষ্ঠ নেতারা রামমন্দির আন্দোলনকে জিইয়ে রাখছেন, এই দৃষ্টান্ত তুলে জেডিইউ যখন বিজেপিকে বিঁধছে, তখন নীতীশের মুখে মোদীর প্রশংসাকেই পাল্টা হাতিয়ার করতে চাইছেন বিজেপি নেতারা।
বার্তা স্পষ্ট, বিজেপি নেতৃত্বের একটা বড় অংশই এখন এনডিএ-র প্রসারের থেকেও মোদীকে সামনে রেখে নিজেদের শক্তি বাড়াতে বেশি মরিয়া। অথচ আডবাণীরা মনে করেন, মোদী নন, কেন্দ্রে সরকার গড়তে গেলে শরিকদের কাছে একটি গ্রহণযোগ্য মুখ তুলে ধরতে হবে বিজেপিকে। ঠিক যে কথা আজ নীতীশও বলেছেন। তাঁরও বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রী হতে চাইলে ২৭২ আসন দরকার। এনডিএ-র প্রসারের দিকে না হেঁটে উল্টো পথে হাঁটছে বিজেপি। তাই এ ছাড়া আর কোনও বিকল্প ছিল না। কিন্তু বিজেপির দাবি, আসলে মোদীর উত্থানকে ভয় পাচ্ছেন নীতীশ। তিনি রাজ্যের ১৬ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটের দিকে তাকিয়ে জোট ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু সব সংখ্যালঘু ভোটই কি নীতীশের ঝুলিতে যাবে? উচ্চবর্ণের ভোটের একটা বড় অংশই তাঁদের কব্জায় বলে দাবি করে বিজেপি নেতাদের বক্তব্য, যে অতি পিছিয়ে পড়া শ্রেণির ভোটে ভরসা রাখছেন নীতীশ, এ বার সেখানেও থাবা বসাবেন মোদী। জোট ভাঙা নিয়ে নীতীশের যুক্তিকে কিছুটা কটাক্ষ করেই বিহার বিজেপির নেতা সুশীল মোদী আজ বলেন, “যিনি ২০০৪ সালে সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, এখন তিনি কী ভাবে সাম্প্রদায়িক হলেন!” তাঁর মন্তব্য, “সুবিধাবাদী রাজনীতির জন্য এর আগেও বিজেপির অনেক নেতাকে সাম্প্রদায়িক বলা হয়েছে। মোদীও ২০১৪ সালের পর আবার ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে যাবেন!” বিহারের বিজেপি নেতারা এখন মোদীকে সামনে রেখেই লড়াইটা চালিয়ে যেতে মরিয়া। অক্টোবরে দলীয় সভায় মোদীকে আনার পরিকল্পনা ছিল তাঁদের। জোট ভাঙার পরে অক্টোবরের আগেই গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীকে বিহারে এনে রাজ্য জুড়ে মোদী-ঝড় তোলার পরিকল্পনা করছেন তাঁরা।
প্রশ্ন হচ্ছে, বিহারে কি নীতীশ অন্য কারও সঙ্গে জোট গড়বেন? কংগ্রেস যথেষ্টই ইচ্ছুক, কিন্তু নীতীশ কি চাইবেন কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়তে? দিল্লিতে কংগ্রেস নেতারা বলছেন, তাঁরা নীতীশকে সঙ্গে চান। কিন্তু সেই বার্তা নীতীশের দিক থেকেই আসতে হবে। কংগ্রেসের অঙ্ক, নীতীশ রাজি হলে লালুপ্রসাদ যাদবকে বাদ দিয়ে রামবিলাস পাসোয়ানকে সঙ্গে নিয়ে নতুন সমীকরণ হতেই পারে। সে ক্ষেত্রে একঘরে হয়ে যাবেন লালু। কারণ আর যা-ই হোক, লালু কখনওই বিজেপির সঙ্গে যেতে পারবেন না। লালু নিজে কী ভাবছেন? মহারাজগঞ্জের উপনির্বাচনের ফল তাঁকে ক’দিন ধরেই চাঙ্গা রেখেছে। এখন নীতীশ-বিজেপি বিচ্ছেদের সুফল ঘরে তুলতে তিনিও মরিয়া। সেই ইঙ্গিত দিয়ে লালুর কটাক্ষ, “এই সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ারই ছিল!”
১৭ বছরের জোট সম্পর্ক। টানা সাত বছর ধরে বিহারে সরকার চালানো। সেই সম্পর্ক রাতারাতি শেষ। দুই শিবিরই মানছে, এ ভাবে জোট ভাঙায় সমস্যা হবেই। কিন্তু উপায় কী! জাতীয় স্তরে মোদী ছাড়া গতি নেই বিজেপির। মোদী-ছোঁয়ায় প্রবল আপত্তি নীতীশের। যার যোগফল, সতেরো বছরের সম্পর্ক সাত দিনে শেষ!
|
পুরনো খবর: বার্তা সঙ্ঘের, তবু নীতীশ-বিচ্ছেদ প্রায় চূড়ান্ত |
|
|
|
|
|