মুছে গেল ৭০ কিলোমিটারের ব্যবধান। প্রতিবাদে কামদুনির সঙ্গে মিলে গেল গাইঘাটা।
চাকরি, ক্ষতিপূরণ-সহ ঢালাও সরকারি সাহায্যের আশ্বাস ফিরিয়ে দিয়ে বারাসতের কামদুনির ধর্ষিত-নিহত তরুণীর পরিবার হত্যাকারীদের চরম শাস্তির দাবি তুলেছে। একই ভাবে শনিবার ব্লক প্রশাসনের দেওয়া এক বস্তা চাল ও শাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে গাইঘাটার নিহত ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রীর পরিবারের লোকজনও অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তির দাবি তুললেন। সেই দাবি যেমন প্রশাসনের কাছে, তেমনই রাজনৈতিক নেতাদের কাছেও। এমনকী, একটি রাজনৈতিক দলের সোমবারের ডাকা বন্ধকেও তাঁরা ধর্তব্যে আনছেন না।
শুক্রবার এলাকার একটি পাটখেত থেকে বাঁ চোখ ওপড়ানো এবং বাঁ কানের কিছুটা অংশ ছেঁড়া অবস্থায় গাইঘাটার রাজাপুর কলোনির বছর বারোর ওই স্কুলছাত্রীর দেহ মেলে। এলাকাবাসী এবং নিহত ছাত্রীর পরিবারের লোকজনের সন্দেহ, এটি শারীরিক নির্যাতন করে খুনের ঘটনা। খুনের অভিযোগে ইতিমধ্যেই পুলিশ সঞ্জয় মণ্ডল নামে ওই ছাত্রীর পড়শি এক যুবককে গ্রেফতার করেছে। শনিবার ধৃতকে বনগাঁ আদালতে হাজির করানো হয়। বিচারক তাকে ন’দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। তদন্তকারীদের অনুমান, ছাত্রীটির মায়ের সঙ্গে সঞ্জয়ের পুরনো শত্রুতা ছিল। তার জেরেই খুন। খুনের ঘটনায় আরও কয়েক জন যুক্ত। সঞ্জয়ের পরিবারের লোকজন পলাতক বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ছাত্রীটির মায়ের সঙ্গে তাঁর স্বামীর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছে কয়েক বছর আগে। মাঠে ঘাস কেটে, বিড়ি বেঁধে ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা শেখাচ্ছিলেন ওই মহিলা। নৃশংস ভাবে মেয়ে খুন হয়ে যাওয়ার পর থেকে তিনি কার্যত বাকরুদ্ধ। শনিবার ব্লক প্রশাসনের তরফে নিহত ছাত্রীর বাড়িতে গাড়ি করে এক বস্তা চাল ও দু’টি শাড়ি পাঠানো হয়। ছাত্রীর পরিবার সেই সাহায্য ফিরিয়ে দেয় বলে জানিয়েছেন বিডিও পার্থ মণ্ডল।
তাহলে কেন ফিরিয়ে দেওয়া হল সরকারি সাহায্য?
ছাত্রীটির মাসি বলেন, “সাহায্য নয়, আমরা অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তি চাই। বড় হলে আমার বোনপোর চাকরির প্রতিশ্রুতিও যদি সরকার দেয়, আমরা তা চাই না। কামদুনির প্রতিবাদ আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে।” এই প্রসঙ্গেই এ দিন ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে অনিল বিশ্বাস স্মারক বক্তৃতায় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নারী নির্যাতনের ঘটনায় রাজ্য সরকারের ‘ভূমিকা’ নিয়ে কটাক্ষ করেন। তিনি বলেন, “ক্ষতিপূরণ নয়, শাস্তি চাই এই যে নতুন দাবি উঠেছে, এটা একটা নতুন উপাদান। সরকার ভাবছে যে কোনও অপরাধ টাকা দিয়ে সামলে নেবে। এখন আর তা পারছে না।”
কামদুনির ঘটনায় নিরাপত্তার অভাবের কথা তুলে ক্ষোভে ফুঁসছে গোটা গ্রাম। যে ভাবে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রীটিকে খুন করা হয়েছে, তাতে এলাকার মহিলা ও শিশুরা আতঙ্কে ভুগছেন। অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তির দাবি তুলেছেন গ্রামবাসীরাও। দফায় দফায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা এ দিন ওই পরিবারকে সমবেদনা জানাতে আসেন। তাঁদের ঘিরে গ্রামবাসীরা জানিয়ে দেন, এখানে কোনও সাহায্য বা সহমর্মিতার প্রয়োজন নেই। ঊষারানি মণ্ডল, শোভা মণ্ডলের মতো কয়েক জন গ্রামবাসী জানান, ছোট ছোট মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে তাঁরা ভয় পাচ্ছেন। নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন।
বিকেলে এলাকার তৃণমূল বিধায়ক সুরজিৎ বিশ্বাস নিহত ছাত্রীর পরিবারকে সমবেদনা জানাতে আসেন। তাঁর কাছে গ্রামবাসীরা এলাকায় চোলাইয়ের ঠেক বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানান। বিধায়ক পুলিশকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। আজ, রবিবার ওই ছাত্রীর বাড়িতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দীপা দাশমুন্সি সমবেদনা জানাতে যাবেন বলে জেলা কংগ্রেস সূত্রে জানানো হয়েছে। সিপিএমের পক্ষ থেকে গাইঘাটা থানায় স্মারকলিপি দেওয়া হয়। হয় পথ অবরোধ। কামদুনি এবং গাইঘাটার ঘটনার প্রতিবাদে কাল, সোমবার বারাসত এবং বনগাঁ মহকুমায় ১২ ঘণ্টার বন্ধ ডেকেছে এসইউসি। সে দিন জেলা জুড়ে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে ডিএসও। শনিবার তারা কলেজ স্ট্রিটে বিক্ষোভও দেখায়। এসইউসি-র মহিলা সংগঠনের পক্ষ থেকে এ দিন গাইঘাটা থানায় বিক্ষোভ ও কিছু ক্ষণ সড়ক অবরোধ করা হয়।
এসইউসি-র ডাকা বন্ধকে সমর্থন করতে পারছে না নিহত ছাত্রীটির পরিবার। ছাত্রীটির মাসি বলেন, “বন্ধ করে কি সমস্যার সমাধান হয়? অপরাধী ধরা পড়ে? আমরা তো শুধু অপরাধীর শাস্তি চাই।” একই বক্তব্য অনেক গ্রামবাসীরই।
কামদুনির পথেই হাঁটছে এ বার গাইঘাটাও।
|