দ্বিতীয় বর্ষের কলেজছাত্রীকে গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় উত্তর ২৪ পরগনার কামদুনিতে মানুষ যে-ভাবে ক্ষতিপূরণ প্রত্যাখ্যান করে অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে এক হয়েছেন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে মন্তব্য করলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। শনিবার এসএফআই আয়োজিত অনিল বিশ্বাস স্মারক বক্তৃতায় বুদ্ধবাবু বলেন, “দু’বছর ধরে যে কোনও অপরাধ হলেই সরকার ভাবত, পয়সা দিয়ে তা সামলে নেব। এ ক্ষেত্রে সেটা করা যায়নি। যে ভাবে ক্ষতিপূরণ নয়, শাস্তি চাই দাবি উঠেছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।” সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় ছাত্রীদের লাঞ্ছিত হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে বুদ্ধবাবুর বক্তব্য, “এঁরা পাশবিকতার শিকার হয়েছেন। এই প্রথম শুনলাম, দরিদ্র পরিবার টাকার কাছে মাথা নিচু করেননি।”
বুদ্ধবাবু মনে করেন, যে কোনও অপরাধ করে ছাড়া পেয়ে যাবে, সমাজবিরোধীদের মধ্যে এমন একটা মনোভাব তৈরি হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ যে ভাবে প্রতিবাদ করছেন, যে ভাবে অর্থসাহায্য প্রত্যাখ্যান করছেন, এই সব ঘটনার মধ্যে যে সব উপাদান দেখা যাচ্ছে, সেগুলির দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। তাঁর বক্তব্য, “সামাজিক মন অপরাধীদের অনেক উপরে। আমরা যদি সমাজে সুস্থ কণ্ঠস্বর এক বার জাগিয়ে তুলতে পারি, তা হলে এই ধরনের অপরাধের মোকাবিলা করা যাবে।”
কামদুনির ঘটনায় এ পর্যন্ত আনসার আলি, সইফুল আলি, গোপাল নস্কর, নুর আলি, ভোলানাথ নস্কর, ভুট্টো মোল্লা, ইনামুল মোল্লা ও আমিন আলিএই ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আরও এক অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা এখনও বাকি। গত ৭ জুনের ঘটনার পরে কামদুনি এখনও অগ্নিগর্ভ। তাই ঝুঁকি এড়াতে সিআইডি অফিসাররা শনিবার কাকভোরে ধৃত আট জনকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যান গোটা ঘটনার পুনর্নির্মাণ করার জন্য। কাজ সেরে ভোরের আলো ফুটতে না-ফুটতেই তাদের নিয়ে ভবানী ভবনে ফিরে যান তদন্তকারীরা। |
সিআইডি সূত্রের খবর, ধৃতদের এক জনকে রাজসাক্ষী করা হতে পারে। গোয়েন্দাদের একাংশের বক্তব্য, ধৃতদের মধ্যে অন্তত চার জন গণধর্ষণ ও খুনে সরাসরি জড়িত। তবে ঘটনার দিন বৃষ্টিতে কিছু নমুনা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তবে আনসার আলির লুঙ্গিতে, ওই জমির ফটকের সামনে ও যার উপর ধর্ষণ করা হয়েছিল সেই তক্তপোষে লেগে থাকা রক্তের সঙ্গে ছাত্রীর রক্তের নমুনা মিলিয়ে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। গোয়েন্দারা জেনেছেন, ওই পাঁচিল ঘেরা জমির ভিতর আগেও বহু দুষ্কর্ম হয়েছে এবং বরাবরই সে সবের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকত জমির কেয়ারটেকার ওই আনসার আলি।
সিআইডি সূত্রের দাবি, জেরায় বাকি অভিযুক্তেরা অপরাধ কবুল করে নিলেও সইফুল আলি গোড়া থেকে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করে আসছিল। পরে স্বীকার করে নিয়েছে, সে দিন সে-ই টেনে-হিঁচড়ে ছাত্রীটিকে উঁচু পাঁচিলের ঘেরাটোপে নিয়ে গিয়েছিল। এবং প্রথম ধর্ষণ করে সে-ই। সইফুল আগে বলেছিল, আর এক অভিযুক্ত গোপাল নস্কর ও সে ঘটনার আগেই খাওয়াদাওয়া সেরে ওই জায়গা থেকে চলে গিয়েছিল। অন্যদের বয়ানের সঙ্গে তা না মেলায় সইফুলকে এর পর বাকিদের সঙ্গে বসিয়ে জেরা করা হয়। এতেই সইফুলের মিথ্যা দাবি ধরা পড়ে যায় বলে জানিয়েছেন তদন্তকারী এক অফিসার। সিআইডি-র এক কর্তা বলেন, “সইফুলের পরে বাকি অভিযুক্তরাও ওই কলেজছাত্রীকে ধর্ষণ করে। পরে শ্বাসরোধ করে, দু’পা দু’দিক থেকে চিরে ফেলে তাঁকে খুন করে।” এ কাজে কে কে হাত লাগিয়েছিল, গোয়েন্দারা এখন তা জানার চেষ্টা করছেন। সিআইডি-র আইজি বিনীত গোয়েল বলেন, “তদন্তের অনেকগুলি দিক এখনও খতিয়ে দেখা বাকি। ধৃতদের জেরা করার কাজ চলছে।” ধৃতদের মধ্যে ভুট্টো ও ইনামুল দাবি করেছে, ওই ছাত্রীকে গণধর্ষণ ও খুনের বিষয়ে তারা কিছুই জানে না। তারা ওই উঁচু পাচিলের ঘেরাটোপে পৌঁছেছিল ঘটনার পরে। সইফুলের মিথ্যে ধরা পড়ার পর এদের দাবিও সব দিক থেকে যাচাই করে দেখছেন গোয়েন্দারা। কলকাতা থেকে বিশিষ্ট জনদের একটি দল শনিবার বিকেলে কামদুনিতে গিয়েছিল। ওই দলে ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব কৌশিক সেন, সুমন মুখোপাধ্যায়, শিল্পী সমীর আইচ, শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহার প্রমুখ। কৌশিকবাবু বলেন, “এই ঘটনার পর মানুষের ক্ষোভকে থিতিয়ে দিতে দেওয়া যাবে না। আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।” এই ধরনের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে আইনি সহায়তা দিতে তাঁরা একটি তহবিল তৈরি গড়ছেন বলে তিনি জানান।
এ দিন গোবরডাঙা-হাবরা-অশোকনগর এবং কলকাতার আলিপুর এলাকার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও ওই ছাত্রীর বাড়ি যান, গ্রামের অবস্থা ঘুরে দেখেন। কামদুনির মানুষ তাঁদের কাছেও ক্ষোভ উগরে দেন, “সবাই তো দেখছেন, কী ভাবে আছি আমরা! যেন রাজ্যের বাইরে বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপ। ন্যূনতম পরিষেবা ও নিরাপত্তা নেই।”
ফরওয়ার্ড ব্লকের পক্ষ থেকে এ দিন বারাসতের চাঁপাডালি মোড়ে প্রতিবাদ সভা ও অবস্থান-বিক্ষোভ করা হয়। বারাসতে একের পর এক নারী নির্যাতন ও সমাজবিরোধী-তাণ্ডবের প্রতিবাদে শিল্পীরা ছবিও আঁকেন। কাল, সোমবার বারাসত ও বনগাঁ মহকুমা বন্ধের ডাক দিয়েছে এসইউসি। একই দিনে এসইউসি-র ডাকে উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে।
|