বার্মিংহ্যাম ফের মিনি ভারত কোহিনুর যেখানে সমর্পিত সেখানেই
ফেরত পাওয়া নতুন ক্রিকেট-ইজ্জত

পাকিস্তান ১৬৫ (৩৯.৪ ওভার)
ভারত ১০২-২ (১৯.১ ওভার)
তার ক্রিকেট কোহিনুর যে মাঠে সমর্পিত হয়েছিল, সেই এজবাস্টনেই যেন ভারত ফিরে পেল ক্রিকেট-ইজ্জতের নতুন মশাল। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি এজবাস্টনেই হাতে তোলার জন্য আরও দু’টো জয়ী ম্যাচের পাদানি চাই। কিন্তু তার আগেও টিম ধোনি যেমন দৃপ্ত ভঙ্গিতে পাকিস্তানকে আট উইকেটে উড়িয়ে দিল, তাতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে প্রথম মিসবার দেশকে হারানোর তথ্যটা তো ঢুকে থাকল। বৃষ্টিতে বারবার বন্ধ হওয়া ম্যাচ নিষ্পত্তি হল ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে। আর চরিত্রে সেটা অন্য পাঁচ দিনের চেয়ে আলাদা। ডিএল মানেই শতকরা দশ বারের মধ্যে ন’বার কোনও টিমের প্রতি চরম অবিচার, অন্যায় আর দুর্ভাগ্য। শনিবারের এজবাস্টনে তেমন কোনও কাহিনি নেই। আজ ক্রিকেটের যে কোনও পদ্ধতিতেই ভারত জিতত। এতটাই গ্রুপ থেকে সব ক’টা ম্যাচ জিতে সেমিফাইনাল যাওয়া তার সঙ্গে তিনটের তিনটেই হেরে টুর্নামেন্ট শেষ করা পাকিস্তানের তফাত। খেলা একবার বন্ধ। একবার চালু। এই করে করে যা নাটক চলল, ভাবাই যায় না। প্রতি বার একটাই মিল। খেলা শুরু হতেই ভারত পাকিস্তানের টুঁটি চেপে ধরে। খেলা শেষে ধোনি যখন নাসের হুসেনকে ইন্টারভিউ দিতে এলেন, ‘ধোনি...ধোনি’ করে এত চিৎকার হচ্ছিল যেন জায়গাটা ঝাড়খণ্ড। আর এমএসডি-র এটা প্রাপ্য। এজবাস্টনে ধোনি-রাজ বিচরণ করল সকাল থেকে সন্ধে।
ভারত অধিনায়কের বিতর্কিত এজেন্ট অরুণ পান্ডেকে দেখলাম এজবাস্টনের তিন তলায়। যে লাউঞ্জে তিনি বসে আছেন, তার নাম ‘১৮৮২’। তার বাইরে আবার ‘রাওডি রাঠৌর’। ‘রাওডি রাঠৌর’। করে তীব্র চিৎকার করছে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মুখ। নীল জার্সি আর পতাকা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে কোন দেশের সমর্থক। কিন্তু যাঁর জন্য তারা গলা ফাটাচ্ছে সে অক্ষয়কুমার কোথায় গেলেন? একটু আগে তো এখানকার ব্যালকনিতেই বসে ছিলেন আর ইএসপিএনের ক্যামেরাম্যান ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। এটা ইডেনের আইপিএল ম্যাচ নয় যে শাহরুখ খান বা সোনি তাঁকে টিভিতে আসতে দেবে না। কিন্তু শেষ বিরতির পর অক্ষয় গেলেন কোথায়? লাউঞ্জের স্বেচ্ছাসেবিকা বলল, বেরিয়ে গেছেন।
কপিল দেব তাঁকেও তখন দেখছি না। শনিবার রাত্তিরেই তাঁর দেশে ফিরে যাওয়ার কথা। কিটব্যাগে ভরে নিয়েছেন এ বারের বিলেত সফরে তাঁর সেরা সংগ্রহ। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ী বায়ার্ন মিউনিখ ফুটবলারদের প্রত্যেকের সই করা জার্সি। কপিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে অন্যতম প্রধান অতিথি ছিলেন। জার্সিতে বিশ্বখ্যাত সব ফুটবলারের অটোগ্রাফ নিতে তাঁর কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু কপিল যে একই সঙ্গে এজবাস্টন থেকে বয়ে নিয়ে যেতে চান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয়। সেটা হাতের কাছে এসেও ক্রমশ বিলম্বিত হয়ে যাচ্ছে। ফ্লাইট টাইমিং তো তা হবে না। সেটা তো পিছোবে না।

মাঠ-ফেরত দর্শকদের উচ্ছ্বাস। শনিবার। ছবি: এপি
এত একপেশে ভাবে ভারত খুব কম ম্যাচে পাকিস্তানকে রগড়েছে! কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও ভারত-পাক ম্যাচেই তো এত বার করে বৃষ্টির জন্য খেলা বন্ধ এবং একটু পরেই শুরু হয়ে এমন মেগাসরিয়ালের মতো চলেনি। একবার একটা রিভাইজড টার্গেট আর ওভার ঠিক হচ্ছে। তার পর আবার সেটা গড়াগড়ি খাচ্ছে নতুন পশলা বৃষ্টিতে। অবিশ্বাস্য জল পরিবহণ ব্যবস্থা এজবাস্টনের। গত ক’ঘণ্টায় ২৪ মিলিমিটার বৃষ্টি সত্ত্বেও মাঠ শুকিয়ে খেলার উপযোগী করে দেওয়া হল। উপমহাদেশে হলে খেলা হতই না।
এই সব ম্যাচে যে টস জিতবে সেই অধিনায়কের সব সময় বাড়তি সুবিধে। সে অবধারিত ফিল্ডিং করবে আর টার্গেট জেনে নামার সুযোগ পাবে। কিন্তু ধোনি সেই সুবিধে বাদ দিয়েও তাঁর রূপান্তরিত টিম নিয়ে ঝকমক করলেন। ভারতীয় ইনিংসের শুরুতেই দেশজ মিডিয়ার কাছে মেল চলে এল, ইন্ডিয়া রবি ও সোমবার ট্রেনিং করবে না। তাতে কী আসে যায় যদি মাঠে নেমে টিম এমন দুর্দান্ত ফিল্ডিং করে। যদি তাঁর তারুণ্যের ঝড়েই চাপা পড়ে যায় মিসবা-উল-হকের পাকিস্তান।
বার্মিংহ্যামে মাঝে মাঝেই ভুল হয়ে যায় এটা ভারত? না বার্মিংহ্যাম? রাস্তা দিয়ে যখন ক্রমশ ভারতীয় মুখ যায়। যখন এজবাস্টনে দ্রাবিড়ের সেঞ্চুরির পর প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। যখন শহরের মধ্যিখানে ‘আশাজ’ রেস্তোঁরায় শুক্রবার রাত্তিরের মতো কিংবদন্তি মালকিনের গানই ভেসে আসে চুরা লিয়া হ্যায় তুমনে যো দিল কো। তখন মনে হতে থাকে এটা মিনি ভারত।
শনিবার মাঠে অবশ্য বোঝা গেল এটা মিনি ভারত নয়। তা বলে বার্মিংহ্যামও নয়। এটা পাকিস্তান! এ তো পরিষ্কার হোমগ্রাউন্ডে খেলছেন মিসবারা।
মুম্বইয়ের প্রখ্যাত ক্রিকেট-ব্যক্তিত্ব সাত সকালেই তাঁদের কথ্য ভাষায় ম্যাচের চরিত্রের কথা পোপট। মানে বেকার ম্যাচ। কিন্তু বার্মিংহ্যামে পাকিস্তানি সাজসজ্জা দেখলে কে বলবে পোপট।
যেন শাদির বারাত যাচ্ছে এই ভঙ্গিতে গোটা শহরে শোভাযাত্রা করে এলেন পাকিস্তানিরা। সংবর্ধনা আর উচ্ছ্বাস শুরু হল সকালে টিম হোটেল থেকেই। কে বলবে এই হোটেলেই ভারতীয়দের আস্তানা আর ম্যাচে এক বলও যে খেলা হয়নি। মাঠেও মানসিক ‘বারাত’ যেটা বেরিয়েছিল, থামিয়ে দিলেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। শুয়ে পড়ে নেওয়া দুর্দান্ত দু’টো ক্যাচে। মরসুমের শেষে এই সব ক্যাচ নেওয়ার মতো ফিটনেস কী করে জিমে এত কম যাওয়া এক ক্রীড়াবিদ রাখতে পারেন, রহস্য।
পাকিস্তান সমর্থকদের আবেগের দাম দেওয়ার মতো অবস্থার কাছাকাছি একবারই এসেছিল। যখন তারা এক উইকেটে ৫০। ধোনির স্যর জাডেজা-র অনবদ্য একটা ডেলিভারি মিসবাকে বোল্ড করে দিতেই ভারত ম্যাচের মাউসটা নিয়ে নিল! আর পিসি ছাড়েনি।
ওয়ারইকশায়ারের প্রাক্তনরা এ দিন উচ্ছ্বসিত ধোনির দল সম্পর্কে। মাইক স্মিথসেই ষাটের দশকের প্রাক্তন ইংরেজ নেতা কারও সঙ্গে দেখলাম, আলোচনা করছেন। “এরাই চ্যাম্পিয়ন হবে।”

জাডেজার মতোই ভাল বল করলেন ম্যান অব দ্য ম্যাচ ভুবনেশ কুমার। ধোনি তঁকে খুব ভাল ভাবে সামলাচ্ছেন। সৌরভের যেমন জাহির, ধোনির তেমনই যেন ভুবনেশ। প্রতি ম্যাচেই টানা সাত-আট ওভার ভুবনেশ বল করছেন। সুইং পাচ্ছেন এখানকার পরিবেশে। প্রাক্তন ইংরেজ ক্রিকেটাররা বলছিলেন, পায়ের মাসলটা ঠিক না করতে পারলে ওর পক্ষে দীর্ঘকালীন টানা সম্ভব হবে না। ভুবনেশনকে যত না নেটে, তার চেয়ে বেশি জিমে সময় কাটাতে হবে। পাকিস্তানের এ সব বিশ্লেষণের মধ্যে যাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। খেলার পর কাঁচুমাচু মুখে ডাভ হোয়াটমোর স্বীকার করে গেলেন, গত শীতে তাঁদের ভুগিয়েছিলেন ভুবনেশ। আজ আবার ঝটকা দিয়ে গেলেন। লিখতে গিয়ে মনে পড়ল, সত্যিই তো। ভুবনেশকে গত শীতেও ভারতে এসে খেলেছে পাকিস্তানিরা। কিন্তু শিখর ধবনকে পায়নি। উপর্যুপরি তৃতীয় ম্যাচে শিখর পারফর্ম করলেন। সইদ আজমল একমাত্র আশা ছিলেন মিসবার। ভারতীয় স্পিনাররা যেখানে টার্ন পেয়েছেন সেখানে আজমল নিশ্চয়ই ভেল্কি দেখাবেন। অথচ ধবনকে কাবুই করতে পারলেন না। প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে এক সফরেই দারুণ জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছেন ধবন। হাফসেঞ্চুরি না হলে কী হবে, যা হাততালি পাচ্ছেন তাতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ব্যবহৃত তাঁর ব্যাটটা রাখতে পারলেও ওয়ারইকশায়ার জাদুঘরের কিছুটা দুঃখ ভোলে। আপাতত সেখানে কোনও ভারতীয়র স্মারক নেই। আর সবচেয়ে মূল্যবান যেটা হতে পারত, জীবনের শেষ টেস্ট ইনিংসে ব্র্যাডম্যানকে বোল্ড করা সেই বলটা তো এখানকার প্লেয়ার এরিক হোলিস হারিয়েই ফেলেছেন সেই কবে ১৯৫৫-তে। হোলিসের মেয়ে কাগজে গত বছর ফের বিজ্ঞাপন দিয়েও প্রয়াত পিতার স্মৃতি বিজড়িত বলটা উদ্ধার করতে পারেনি।
এজবাস্টনে এ দিন অনেকের মনে হল, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে পাকিস্তানি যা পারফরম্যান্স। হোলিসের বলের মতো তাদের ওয়ান ডে ঐতিহ্যও না হারিয়ে যায় কোন দিন!
ম্যাচ শেষ হওয়ার ঘণ্টাখানেক বাদে যখন পাকিস্তান টিম বাস বেরোচ্ছে, কিছুটা এগোতেই বিক্ষুব্ধ সমর্থকরা ঘিরে ধরেন সেই বাস। তীব্র চাপড়ও মারা হতে থাকে। চালক কোনওক্রমে স্পিড বাড়িয়ে কোচ নিয়ে বেরিয়ে যান। এর মিনিটখানেকের মধ্যে ভারতীয়দের টিমবাস ঘেরাও করে কিছু লোক। তফাতের মধ্যে তাদের কোনও ক্ষোভ নেই। আবদার রয়েছে। তারা ধোনিকে কাছ থেকে দেখতে চায়।
বার্মিংহ্যাম তখন আর বার্মিংহ্যাম নয়। পাকিস্তান নয়। শনিবার সন্ধ্যা থেকে ফের মিনি ভারত!

পুরনো খবর:




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.