চার বছর হয়ে গেল দেশ থেকে কার্যত তিনি নির্বাসিত। ক্রিকেটেরও কোনও পদেটদে থাকার প্রশ্ন নেই। তবু এখনও তাঁকে ঘিরে দু’দেশের সমর্থকদের এমন ঝাঁপিয়ে পড়া। ছবি তোলা আর অটোগ্রাফ নিতে যাওয়া। যেন কোনও তারকা ক্রিকেটার। দু’দিকের চুলটা একটু পাতলা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আর কোনও তফাত নেই। দু’দিকে দু’জন সাহেব দেহরক্ষী। বার্মিংহ্যাম থেকে রাতেই ফিরে যাবেন লন্ডন। রাত্তিরে এখানে থাকার উপায় নেই। পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শওকত আজিজকে নৈশভোজে আপ্যায়িত করবেন যে। আনন্দবাজারকে এজবাস্টন মাঠের কোণার সোফায় দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে আরওই বোঝা গেল ললিত মোদী আজও আদি এবং অকৃত্রিম।
প্রশ্ন: সঙ্গে বডিগার্ড নিয়ে ঘুরছেন কেন?
ললিত: (হালকা হাসি) জানেন না, আমার প্রাণনাশের হুমকি আছে! সন্ত্রস্ত থাকতে হয়। দু’বার অ্যাটেম্পট হয়ে গিয়েছে। সরি, তিন বার। এক বার দক্ষিণ আফ্রিকায়। এক বার তাইল্যান্ডে। আরও এক বার দেশে।
প্র: আপনাকে কে মারতে চাইবে? কেন-ই বা চাইবে?
ললিত: দাউদ ইব্রাহিম আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা। প্রথম তিনটে আইপিএল থেকে ওরা যে পরিমাণ টাকা রোজগার করতে চেয়েছিল তার কিছুই আমি করতে দিইনি। তখন থেকে আমার ওপর রাগ!
প্র: দাউদ...
ললিত: বিশ্বাস হচ্ছে না তো? আগে তো কেউ বিশ্বাস করত না। এখন ধীরে ধীরে হবে। দেখছেন না স্পট ফিক্সিং কেসে দাউদের নাম সেই শেষে বেরিয়েই পড়ল। ওর সিন্ডিকেট গোটা ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণ করে। সেখানে আমি ছিলাম একটা বড় বাধা।
প্র: দেশে ফিরছেন না কেন? লোকের ধারণা, মুম্বইয়ে নামলেই গ্রেফতার হতে হবে আশঙ্কায়।
ললিত: একেবারেই না। দেশে গেলে আমার বা আমার পরিবারের প্রাণনাশের আশঙ্কা রয়েছে। সেই ঝুঁকি কে নেবে? ইংল্যান্ড তুলনায় অনেক সেফ দেশ। যে দিন মনে করব দেশে গেলে আমি বা আমার পরিবার নিরাপদ, সে দিন যাব।
প্র: চার বছর হয়ে গেল প্রবাসে। অসুবিধে হয় না?
ললিত: খুব অসুবিধে হয়। আমাদের মোদী ইন্ডাস্ট্রিজের এত বড়, হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা। এখান থেকে ম্যানেজই করা যায় না। খুব সমস্যা।
প্র: অনেকে মনে করে বিজেপি ক্ষমতায় এলে আপনি আবার দেশে ফিরবেন?
ললিত: আরে না না। ভুল ধারণা। আমি বিজেপির কিছু লোকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। তার মানেই আমি বিজেপি নই। সে তো আমাদের পরিবারের সঙ্গে কংগ্রেসেরও বহু বছরের সম্পর্ক।
প্র: নরেন্দ্র মোদীকে বিজেপি তাদের মুখ হিসেবে আগামী দিনের জন্য তুলে ধরল। সিদ্ধান্তটা কেমন?
ললিত: দারুণ (উচ্ছ্বসিত) নরেন্দ্র ভাই দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে দুর্ধর্ষ হবে ব্যাপারটা।
প্র: নরেন্দ্র মোদী প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়ান ক্রিকেট বোর্ড?
ললিত: যে লোকটা দেশের প্রধানমন্ত্রী হবে সে কি আর রাজি হবে ক্রিকেট বোর্ড চালাতে (ম্লান হাসি)? সে হবে না। যদিও নরেন ভাই হলে দারুণ হত।
প্র: অরুণ জেটলি?
ললিত: (মুখচোখ কঠিন) খুব খারাপ। বোর্ডে এখন যা যা অনাচার, খারাপ অবস্থা, স্বেচ্ছাচার আর দুর্নীতি তার জন্য শ্রীনি প্রথম দায়ী হলে আর এক জন দায়ী হল জেটলি। মাস্টার ব্যাকরুম অপারেটর। ঘৃণ্য কাজকর্ম। সব আইনি খসড়াগুলো করে দেয়। একেবারে অপদার্থ। জেটলি চালাবে ইন্ডিয়ান বোর্ড! দিল্লি ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন যে চালাতে পারে না, সে চালাবে দেশের বোর্ড?
|
এজবাস্টনে মোদী। শনিবার। ছবি: গৌতম ভট্টাচার্য |
প্র: কী বলছেন? জেটলিকে তো বোর্ডের অনেকেই খুব নৈতিক বলে মনে করেন। তাঁর সঙ্গে একমত হন বা না হন।
ললিত: নৈতিক ছাড়ুন তো। বললাম তো বোর্ডের গত ক’বছরে যাবতীয় অপকর্মের পিছনে আমি ওর কালো হাত দেখতে পাই। ওকে গিয়ে বলুন না, ললিত এবিপি-তে এই বলেছে। সাহস থাকে তো মামলা করুক আমার বিরুদ্ধে।
প্র: লোকে বলে আপনার পরিচালিত আইপিএলেও ফিক্সিং হয়েছে।
ললিত: একটা প্রমাণ করুক না একটা! ফ্র্যাঞ্চাইজিদের কাছে গিয়েই আমার সম্পর্কে একটা ভোট নিন না। দেখুন ওরা কী বলে বোর্ড অফিশিয়ালদের সম্পর্কে আর ললিত মোদী সম্পর্কে। এখুনি ফোন করে দেখুন।
প্র: ডালমিয়া বলেছেন, তাঁর ব্যক্তিগত মত আইপিএল এক বছর বন্ধ রেখে শুদ্ধকরণ অভিযান চালানো হোক।
ললিত: তাতেও লাভ হবে না যদি এই বোর্ডই আইপিএল চালাতে থাকে। এদের প্রত্যেকের কোনও না কোনও অভিসন্ধি আছে। আমার মতে আইপিএলটা ইন্ডিয়ান বোর্ডের থেকে বার করে নেওয়া উচিত। পুরো ফ্র্যাঞ্চাইজিদের হাতে তুলে দেওয়া হোক। ওরাই লিগটা চালাক। অ্যাদ্দিনে ওরা ক্রিকেটের ব্যাপারস্যাপার বুঝেও গেছে।
প্র: ললিত মোদীকে ভবিষ্যতে দেখা যেতে পারে আইপিএলে?
ললিত: এই লোকগুলোর সঙ্গে কখনও নয়। প্রত্যেকে এক একটা কভার আপ অপারেশনের সঙ্গে যুক্ত। প্রত্যেকে কেলেঙ্কারিগুলো চাপা দিয়ে যাচ্ছে। কোথায় নামিয়ে আনছে ওরা আইপিএলকে! কোন জিনিস আমি তৈরি করে দিয়েছিলাম। আর সেটাকে ওরা এমন নামিয়েছে যে, এ বার যখন ব্রডকাস্টিং আর স্পনসরশিপ স্বত্ত্ব বিক্রি হবে কিছুতেই ওরা আগের বারের চেয়ে বেশি দাম পাবে না। অথচ চার বছরে দর দ্বিগুণ হওয়ার কথা।
প্র: একটা ধারণা আছে শ্রীনিবাসনই বোর্ড চালাচ্ছেন।
ললিত: আবার কী! কোনও সন্দেহ আছে নাকি? সমস্ত কিছু শ্রীনিই নিয়ন্ত্রণ করে। সব গট আপ। এই যে জেটলি মিটিংয়ে গেল না সব আইওয়াশ। আমার বেলা আইপিএল শেষ হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে সাসপেনশনের চিঠি ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তো এ বার কী হল? এ বার আমার বন্ধু বিন্দ্রা ছাড়া একটা লোকও কোনও কথা বলল না কেন?
প্র: ডালমিয়ার হাতে ক্ষমতা নেই বলছেন?
ললিত: ধুর, ক্ষমতা! স্ট্যাচু প্রেসিডেন্ট উনি। কী করে প্রেসিডেন্ট হলেন? স্পেশ্যাল এজিএম ডেকে ওঁকে করা হল না কেন? বললাম না, সব শ্রীনির খেলা।
প্র: শ্রীনি বলছেন, যে দেশান্তরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তার কথার আর কী জবাব দেব?
ললিত: পালিয়ে তো বেড়াচ্ছে শ্রীনি। এখন স্বমূর্তি এমন ফাঁস হয়ে গেছে যে, কোনও প্রোটেকশনেই কিছু হবে না। দুঃখের হল ভারতীয় ক্রিকেটকে ও এমন বদনাম করে দিয়ে গেল যে, সর্বত্র খারাপ আলোচনা। ইংল্যান্ডে এত দিন এসেছেন, শোনেননি? লজ্জায় কান পাতা যায় না।
প্র: আপনার আমলেও তো আইপিএলে আর্থিক কারচুপির অভিযোগ আছে।
ললিত: চার বছর হয়ে গেল তো। একটাও প্রমাণ হল না কেন? আমি তো এখানেই আছি। সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
প্র: কিন্তু আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাজ কুন্দ্রাও তো জড়িত বলছে।
ললিত: সত্যি হলে সেটা খুব দুর্ভাগ্যজনক। আমার মতে রাজ কুন্দ্রার বিরুদ্ধেও তা হলে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। টিম মালিক হয়ে তুমি কিছুতেই বেটিং করতে পারো না। এখুনি বাতিল করে দেওয়া হোক সিএসকে আর রাজস্থান রয়্যালসকে! এখুনি! নতুন টেন্ডার ডাকো। নতুন দু’টো টিম নাও।
প্র: আপনার কি মনে হয় মহেন্দ্র সিংহ ধোনি অন্যায় সুবিধে ভোগ করেছেন এবং করে যাচ্ছেন শ্রীনির আমলে?
ললিত: সেটা বলতে পারব না। আমার কোনও আইডিয়া নেই। আমি যেটুকু দেখেছি, ধোনি খুব ভদ্রলোক। যত যা-ই বলুন, এমএসের মধ্যে একটা ব্যাপার আছে!
প্র: আসন্ন সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট পদে পুনর্নির্বাচনের সময় একটা সুযোগ আসবে। তখন ডালমিয়া দৃঢ়তা দেখালে কি শ্রীনি-কে রোখা সম্ভব নয়?
ললিত: ধুর, ডালমিয়ার হাতে জিরো পাওয়ার। যতই উনি প্রেস ইন্টারভিউ দিয়ে বেড়ান, ওঁকে বসিয়েছে তো শ্রীনি। সব কিছু চেন্নাই থেকে ঠিক হয়। চেন্নাইয়ের অঙ্গুলিহেলনে গোটা বিশ্ব ক্রিকেট চলেই তো সব কিছু গোল্লায় গ্যাছে। শ্রীনি তো কখনও নিজেকে ঈশ্বর মনে করে। কখনও সম্রাট। আর এই তাবেদারগুলো তাতে সায় দিয়ে চলে। আপনি জেটলি বলছিলেন না? ওর কাজ হল নোংরা সব স্ট্র্যাটেজি তৈরি করা। আর মিটিংয়ের মিনিটস আগাম তৈরি করে রাখা।
প্র: সচিব আর কোষাধ্যক্ষ তো অন্তত প্রতিবাদে ইস্তফা দিয়েছেন।
ললিত: হ্যাঁ, দেরি করে হলেও দিয়েছে।
প্র: আপনার মতে, নিশ্চয়ই সেটাও সাজানো? আরও একটা ‘কভার আপ’?
ললিত: না, সেটা সাজানো নয়। জাগদালে আর শিরকে দু’জনকে আমি খুব ভাল করে চিনি। ওরা আপাদমস্তক সৎ লোক।
প্র: শ্রীসন্তরা যে জামিন পেয়ে গেলেন, তাতে কি আপনি হতাশ?
ললিত: সে তো আমাদের দেশে বেটিং নিয়ে আইন যথেষ্ট জোরাল নয়। জামিন পেতেই পারে। ওটা নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। আমার সমস্যা হল, খেলাটার সুনামের ওরা কী বারোটাই না বাজিয়ে গেল।
প্র: আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিদের লিগ করে দেওয়ার যে পরামর্শ আপনি দিচ্ছেন, অবশ্যই বিসিসিআই তাতে রাজি হবে না। অবাস্তব প্রস্তাব হবে না?
ললিত: অবাস্তব হলে আইপিএল বন্ধ হয়ে যাক।
প্র: আপনি বলছেন, আইপিএল বন্ধ হয়ে যাক! আইপিএলের জনক।
ললিত: ইয়েস। জিরো টলারেন্স চালু না করা গেলে। জিনিসটা পরিচ্ছন্ন না করলে। শ্রীনির ক্লেদাক্ত সংসার বন্ধ না করা গেলে, আইপিএল-ই মুলতবি থাক। আবার ফিরুক সম্পূর্ণ পরিচ্ছন্ন হয়ে। সে যখনই হোক। যবেই হোক!
প্র: এত তাড়াহুড়ো করে কোথায় বেরিয়ে যাচ্ছেন?
ললিত: লন্ডন ফিরে যেতে হবে। পাকিস্তানের এক্স প্রাইম মিনিস্টার শওকত আজিজ আজ ডিনারে আমার গেস্ট। |