|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
সটীক মানচিত্র এক সামগ্রিক অভিজ্ঞতা |
গৌতম সেনগুপ্ত |
অ্যাটলাস অব এনশিয়েন্ট ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি, ইরফান হাবিব, ফৈজ হাবিব। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ৪৩৫০.০০ |
স্থান-কাল-পাত্র এই তিনের পারস্পরিক সম্পর্কের জটিল টানাপড়েনে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে ইতিহাস। ইতিহাসের বিচিত্র বিন্যাসের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে টীকা-ভাষ্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ মানচিত্র। মুদ্রিত পাঠের পরিপূরক। ইতিহাসকার মাত্রেই এক অর্থে মানচিত্র নির্মাতা। সাদাসিধে স্কেচ-ম্যাপ থেকে উন্নত কারিগরি নির্ভর অ্যাটলাস— সর্বত্রই মানচিত্র পাঠকের মনের দিগন্তকে প্রসারিত করে বহুদূর। ভারতবর্ষের ইতিহাস চর্চা প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র অর্জন করার একটি অনিবার্য পরিণাম হল বিভিন্ন ধরনের মানচিত্রের ব্যাপক ব্যবহার— পাঠ্যপুস্তকে এবং মান্য গবেষণা কর্মে।
অনেকেরই স্মরণে আছে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত কলিন ডেভিসের অ্যান হিস্টরিকাল অ্যাটলাস অব ইন্ডিয়ান পেনিনসুলা-র কথা। একগুচ্ছ মানচিত্রে ধরা হয়েছিল বিভিন্ন সাম্রাজ্যের সীমানা, আর বিভিন্ন সময়পর্বে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ অধিকার প্রসারণের কথা। কলিন ডেভিসের প্রয়োজনীয় কাজটির ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে বহুগুণ— বিষয়ের বৈচিত্রে এবং পদ্ধতিগত উৎকর্ষে। ১৯৭৮-এ মার্কিন পণ্ডিত জোসেফ ই সোয়ার্জবার্গ প্রকাশ করেন বড় আকার, বহু বর্ণে মুদ্রিত আ হিস্টরিকাল অ্যাটলাস অব সাউথ এশিয়া। ইরফান হাবিবের আ হিস্টরিকাল অ্যাটলাস অব মুঘল ইন্ডিয়া প্রকাশিত হয় ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে। গত কয়েক দশকে আঞ্চলিক স্তরে নানা ঐতিহাসিক মানচিত্র তৈরি হয়েছে, যেমন ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়, গৌতম সেনগুপ্ত এবং শম্ভু চক্রবর্তী সম্পাদিত অ্যান অ্যানোটেটেড আর্কিয়োলজিকাল অ্যাটলাস অব ওয়েস্ট বেঙ্গল (প্রথম খণ্ড, ২০০৫)। অধ্যাপক সুব্বারায়ালুর নেতৃত্বে দক্ষিণ ভারতের ঐতিহাসিক মানচিত্র সংকলনের কাজ চলছে।
১৯৮৬ থেকে ২০০৭-এর মধ্যে ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেস-এর বিভিন্ন বার্ষিক অধিবেশনে ইরফান হাবিব এবং তাঁর পুত্র ফৈজ হাবিব যৌথ ভাবে উপস্থাপন করেন একগুচ্ছ মানচিত্র এবং প্রাসঙ্গিক তথ্যপঞ্জি। এ বার তার সুসংস্কৃত রূপ পাওয়া গেল আলোচ্য বইয়ে। কালানুক্রম প্রাচীনতম সময় থেকে আটশো খ্রিস্টাব্দ। লক্ষণীয়, এই মানচিত্র-সংকলনের নাম মুঘল ভারতের ঐতিহাসিক মানচিত্রের ধাঁচে প্রাচীন ভারতের ঐতিহাসিক মানচিত্র নয়— এটি প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের মানচিত্র। এই মানচিত্র-সংকলনের অভীষ্ট-পাঠক কারা, আর এর উদ্দেশ্যই বা কী? দুটি প্রশ্নেরই উত্তর দেওয়া আছে নির্দ্বিধ উচ্চারণে, মানচিত্রগুলি ব্যবহার করবেন প্রাক-ইতিহাস এবং প্রাচীন ইতিহাসের ছাত্র-গবেষককুল, একটি ‘রেফারেন্স’ হিসেবে। তবে ‘রেফারেন্স’ গ্রন্থের সুনির্দিষ্ট সীমানা অতিক্রম করে গ্রন্থটির ব্যবহার হবে নানা ভাবে। এই সংকলনের উদ্দেশ্য একগুচ্ছ মানচিত্রের মাধ্যমে প্রাচীন ভারত বিষয়ক অনেক ক’টি মৌলিক প্রসঙ্গের উপস্থাপনা, এদের মধ্যে আছে জনগোষ্ঠীর চংক্রমণ, প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান নির্ভর ‘আঞ্চলিক সংস্কৃতি’র উদ্ভব, রাষ্ট্রের সীমারেখা, প্রশাসনিক কেন্দ্র, অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য, কারিগরির বিকাশ। |
রাজা অশোক। কাঙ্গানাহাল্লি, কর্নাটক। ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণের সৌজন্যে |
তত্ত্ব ও তথ্যের এক সমৃদ্ধ ভাণ্ডার ধরা আছে বারোটি বড় মাপের মানচিত্র এবং ১১০ পৃষ্ঠায় দু-কলমে ছাপা টীকা-ভাষ্যে। সঙ্গে অতিরিক্ত প্রাপ্তি বিস্তৃত গ্রন্থ/প্রবন্ধপঞ্জি এবং ৩টি অতীব প্রয়োজনীয় বিষয়সূচি (ইনডেক্স), স্থাননাম-জনগোষ্ঠী-ভূখণ্ড এবং রাজ্য, এবং প্রাচীন নদীগুলির নাম। সব মিলিয়ে এক বিপুল আয়োজন— চোখ ও মনের প্রভূত খোরাক। মানচিত্রগুলির বিষয়বস্তুর আভাস দেওয়া যেতে পারে: প্রবেশক মানচিত্রটি ভারতীয় উপমহাদেশের ভৌগোলিক পরিচিতি, সূত্র অক্সফোর্ড রেফারেন্স অ্যাটলাস ফর ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড।
অন্য মানচিত্রগুলি হল
১. মানবগোষ্ঠীর উদ্ভব এবং প্রসার,
২. নব্যপ্রস্তর যুগ,
৩. সিন্ধু সভ্যতা,
৪. প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদাননির্ভর সংস্কৃতি (১৮০০-৬০০ খ্রি.পূ.),
৫. ভারতের ঐতিহাসিক ভূগোল (১৮০০-৬০০ খ্রি.পূ.),
৬. ভারত (৬০০-৩২০ খ্রি.পূ.),
৭. মৌর্যকালীন ভারত,
৮. ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্র, (২০০ খ্রি.পূ.-৩০০ খ্রি.),
৯. ভারতের অর্থনৈতিক ভূগোল (১-৩০০ খ্রি.),
১০. ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্র (৩০০-৫৫০ খ্রি.),
১১. ভারতের রাজনৈতিক ভূগোল (৫৫০-৭৫০ খ্রি.)
এবং
১২. ভারতের অর্থনৈতিক মানচিত্র (৫০০-৮০০ খ্রি.)।
এই আপাত সরল বিষয় বিন্যাসের অন্তরালে সক্রিয় আছে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ভাবনার একটি তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণাত্মক কাঠামো। বারোটি মানচিত্রের পথ অনুসরণ করে পাঠক অনুধাবন করতে পারবেন প্রাচীন ভারত-ইতিহাসের বহুমাত্রিক, বহুমুখী, বহুস্তরে বিন্যস্ত জঙ্গমতাকে। দামোদর ধর্মানন্দ কোশাম্বী এবং রামশরণ শর্মার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ভারত ইতিহাসের যে বহুত্ববাদী চরিত্র উন্মোচিত হয়েছে, এই মানচিত্র তাকে যথার্থই দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তুলেছে। অনিবার্য ভাবে এসে পড়ে ৩৫ বছর আগে প্রকাশিত সোয়ার্জবার্গ কৃত অ্যাটলাস-এর প্রসঙ্গ। সোয়ার্জবাগর্ সাহিত্যগত (টেক্সচুয়াল) উপাদানসমূহকে যে নিশ্চয়তার সঙ্গে মানচিত্রে রূপায়িত করেছিলেন— হাবিবদের কাজে সেই অনায়াস নিশ্চয়তার পরিবর্তে চোখে পড়বে ইতিহাসের উপাদানের ব্যবহারে পরিশীলিত সতর্কতা। তাই এই সংকলনে মহাকাব্য বা পুরাণ নির্ভর মানচিত্র অনুপস্থিত। প্রাচীন ইতিহাসের কোনও একটি পর্বের মানচিত্রায়ণে সেই পর্ব সংক্রান্ত সব ধরনের ঐতিহাসিক উপাদান অত্যন্ত সতর্ক ভাবে বিশ্লেষণ করেই আহরিত তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সিন্ধু সভ্যতা বিষয়ক মানচিত্রটির উল্লেখ করা যেতে পারে। সিন্ধু সভ্যতার উদ্ভব এবং বিকাশের বিভিন্ন পর্ব, জনবসতির প্রধান কেন্দ্রসমূহ, তাদের বিস্তার, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ব্যবহারের নিদর্শন, ভূপ্রকৃতির চরিত্র এবং বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত প্রত্নউপাদানের বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি নির্ভর সময়ক্রম— বিবিধ তথ্য এই মানচিত্রে উপস্থাপিত হয়েছে অত্যন্ত দক্ষতায়। ফলত সিন্ধু সভ্যতার বিকাশের বহুমাত্রিক গতিপথ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একই ভাবে, নব্যপ্রস্তর যুগের মানচিত্র থেকেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে একটি ছবি, কেমন করে আফগানিস্তান-পাকিস্তানের কয়েকটি কেন্দ্র ধরে নব্যপ্রস্তর যুগের অতীব গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তন, গর্ডন চাইল্ডের ভাষায় ‘নিয়োলিথিক রেভোলিউশন’— প্রসারিত হল ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে। হাবিবরা নব্যপ্রস্তর যুগের পরিবর্তনের অন্য একটি গতিপথেরও দিকচিহ্ন নির্ণয় করেছেন— চিন, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, উত্তর-পূর্ব ভারত— এই পথ অনুসরণ করে। চতুর্থ ও পঞ্চম মানচিত্র দুটি এক অর্থে পরস্পরের পরিপূরক। একটি প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান নির্ভর, অন্যটির তথ্যভিত্তি বৈদিক সাহিত্য। সম্পাদকরা একই সময়ক্রমের জন্য দুটি মানচিত্রের উপস্থিতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন— প্রত্নতত্ত্ব এবং সাহিত্যনির্ভর তথ্যের যথাযথ সমন্বয়ের সমস্যার নিরিখে। পঞ্চম মানচিত্রে অবশ্য উপস্থাপিত হয়েছে ভাষা ব্যবহারের প্রসঙ্গ। সব মিলিয়ে আলোচ্য সময়ক্রমের বৈচিত্র এবং সমস্যা পাঠক-দর্শকদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ছয় এবং সাত সংখ্যক মানচিত্র দুটিতে মহাজনপদ পর্ব থেকে মৌর্য সাম্রাজ্যের উদ্ভব এবং প্রসারকে ধরা হয়েছে। জনগোষ্ঠীর পরিচিতিতে চিহ্নিত রাষ্ট্র (স্টেট) থেকে প্রথম সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যের উত্থান— এই পর্বান্তর চিত্রিত হয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান (মৃৎপাত্র, মুদ্রা, লেখ ইত্যাদি) এবং সাহিত্য নির্ভর উপকরণ (বৌদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থ, দেশীয় এবং অভারতীয় বিবরণ) সমূহের সমন্বিত বিশ্লেষণ ব্যবহারে। এক-আধটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এই মানচিত্রে বিশদ তথ্য পাওয়া যাবে— নগর-অঞ্চল-ভূপ্রকৃতি এবং ভাষাগত বৈচিত্র অর্থনৈতিক উপকরণ এবং সীমান্ত বিষয়ে। পরবর্তী পর্যায়ের মানচিত্র সমূহে ব্যবহৃত তথ্য আহরিত হয়েছে লেখমালা থেকে। লেখকরা বিনম্র ভাষায় তাঁদের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে, লেখমালা বিধৃত তথ্যাবলির বহুমাত্রিক চরিত্র এবং লব্ধ তথ্যের সৃজনশীল প্রয়োগ— সপ্তম থেকে দ্বাদশ সংখ্যক মানচিত্রগুলিকে সমৃদ্ধ করেছে।
হাবিবদের টীকাভাষ্য সহ মানচিত্র একটি সামগ্রিক অভিজ্ঞতা। এ ধরনের প্রয়াসে মানচিত্রকারদের তাত্ত্বিক অবস্থান এবং তথ্য নির্বাচনের গ্রহণ-বর্জন প্রক্রিয়াটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীন ভারত সংক্রান্ত প্রাথমিক উপাদান, তা মুদ্রা, লেখ, প্রত্নতাত্ত্বিক মৃৎপাত্র, দেশীয় বা অভারতীয় বিবরণ যাই হোক না কেন, ব্যবহারের ক্ষেত্রে সার্বিক নিশ্চয়তার কোনও স্থান নেই। আর্য সমস্যা থেকে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের কালক্রম, উৎখননে প্রাপ্ত উপাদানের স্তর বিন্যাস, মুদ্রা বা লেখমালার গূঢ়ার্থ, অনিশ্চয়তা ব্যাপ্ত নানা স্তরে, ভিন্ন ভিন্ন পর্বে। এই বহুমাত্রিক, বহু বিচিত্র উপাদানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও একই ভাবে বহুমুখী ও সমস্যা কণ্টকিত। ইরফান হাবিব ও ফৈজ হাবিবের কৃতিত্ব, তাঁরা এই বিপুল তথ্যভাণ্ডার অবলম্বনে নিপুণ বিশ্লেষণী দক্ষতায় গড়ে তুলেছেন সংকলনটি। আদিপর্বের ভারত ইতিহাসের প্রধান সমস্যাগুলির যথার্থ, যুক্তিগ্রাহ্য চিত্রণ বিশেষজ্ঞ এবং উৎসাহী পাঠককুল উভয়কেই সমান ভাবে উদ্দীপ্ত করবে। |
|
|
|
|
|