এ রাজ্যে দুই বিপরীত শক্তি কাজ করিতেছে। এক দিকে শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, রাজনীতিতে মেয়েরা পুরুষদের পশ্চাতে ফেলিবার উপক্রম করিতেছে। ছাত্রদের চাইতে অধিক ছাত্রী মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসিতেছে, পুরুষদের চাইতে অধিক মহিলা পঞ্চায়েত-পুরসভার নির্বাচনে দাঁড়াইতেছে। অন্য দিকে ঘরে-বাহিরে মহিলাদের উপর হিংসার ঘটনা ক্রমশ বাড়িতেছে। গত বছর মহিলাদের উপর অপরাধের ঘটনা এ রাজ্যে ৩০ হাজার ছাড়াইয়াছে। জনসংখ্যার নিরিখে দেশে চতুর্থ স্থানে থাকিয়াও পশ্চিমবঙ্গ নারী নির্যাতনের ঘটনায় প্রথম স্থানে রহিয়াছে, ইহা রাজ্যবাসীকে আঘাত করিয়াছে। সেই আঘাত আরও তীব্র হইয়াছে, কারণ ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর এই প্রতিবেদন প্রকাশ হইবার পূর্বে পরপর বারাসতের কামদুনি এবং নদিয়ার গেদেতে দুই ছাত্রীর ধর্ষণ ও হত্যা ঘটিয়াছে ভরা দ্বিপ্রহরে। স্পষ্ট হইয়াছে যে, নিজের বাড়ির রাস্তাও মেয়েদের জন্য নিরাপদ নহে। প্রতিবেশীদের বয়ানে স্পষ্ট, গ্রামের সকল কিশোরী-তরুণীকেই ওই সকল রাস্তায় বাহির হইলে কটূক্তি, নির্যাতন সহিতে হয়। শহরেও অবস্থা তথৈবচ। বেঙ্গালুরুর জনসংখ্যা কলকাতার দ্বিগুণ, অথচ নারীনিগ্রহের সংখ্যা দুই শহরে প্রায় এক। কেবল পরিসংখ্যানের নিরিখে নহে, নিত্যদিনের অভিজ্ঞতার নিরিখেও। বারাসত ও কলিকাতায় গত কয়েক দিন ধরিয়া নারী নির্যাতন বিরোধিতায় ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশও সেই ইঙ্গিতই দিতেছে।
জনসমাজ সত্যটি যত স্পষ্ট করিতেছে, জনপ্রতিনিধিরা ততই জোর গলায় তাহাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করিতেছেন। রাজ্য সরকার দাবি করিয়াছে যে, অপরাধ নহে, নথিভুক্তির হার অধিক। কিছু পুলিশকর্তার যুক্তি, অন্য রাজ্যে মহিলারা থানায় যাইতে সাহস করেন না, পশ্চিমবঙ্গে তাহারা সহজেই তাহা পারেন। অপরাধের নথিভুক্তি বেশি এই জন্যই। এই বক্তব্যের পক্ষে তথ্য-পরিসংখ্যান ঠিক কী, কোন কোন রাজ্যে সমীক্ষা করিয়া তাঁহারা এই সিদ্ধান্তে আসিয়াছেন, তাহা অবশ্য কর্তারা প্রকাশ করেন নাই। তবে এ রাজ্যে মহিলাদের অভিজ্ঞতা বিপরীত সাক্ষ্যই দেয়। নারীপাচার, বধূনির্যাতন থেকে যৌননিগ্রহ, যে কোনও নালিশ লইয়া থানায় গেলে হয়রানের একশেষ হইতে হয়। অভিযুক্ত প্রভাবশালী হইলে নথিভুক্তি আরও কঠিন হয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন পুলিশের দুর্নীতি লইয়া কম সমালোচনা করেন নাই। নিজে পুলিশমন্ত্রী হইবামাত্র তিনি সকল পুলিশকে সদাশয় ভদ্রলোক বলিয়া বুঝিয়াছেন, ইহা আশ্চর্য বটে।
ততোধিক আশ্চর্য এই যে, বিধানসভায় অধিক নথিভুক্তির যুক্তি দিতে গিয়া মুখ্যমন্ত্রী ভুলিয়াছেন, এ রাজ্যে প্রতিদিন যত অপরাধ মেয়েদের উপর ঘটিয়া থাকে তাহার অতি সামান্য অংশই থানা অবধি পৌঁছায়। যদি বালিকা-কিশোরী-তরুণীদের উপর সংঘটিত প্রতিটি অপরাধ লিখিতে হইত, তবে রাজ্যের সকল থানায় সকল পুলিশ কর্মী ২৪ ঘণ্টা কেবল কেস ডায়েরি লিখিলেও যথেষ্ট হইত না। অতএব ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর সহিত বৃথা তর্ক করিয়া লাভ নাই। উত্তর প্রদেশ কিংবা বিহারের অপেক্ষা পশ্চিমবঙ্গ ভাল কি মন্দ, সেই আলোচনাও অর্থহীন। আজ রাজ্য সরকারকে স্বীকার করিতে হইবে, পুলিশ-প্রশাসন-রাজনৈতিক দলের সমর্থন ভিন্ন চোলাই মদের দোকান চলিতে পারে না, গ্রামে-শহরে দুর্বৃত্তরা নিয়মিত নারী-নিগ্রহ করিয়াও পার পাইতে পারে না। মুখের কথায় নারীনির্যাতনের প্রতি ‘শূন্য সহনশীলতা’ বলিলেও বিভিন্ন সময়ে মুখ্যমন্ত্রীর নিজের মন্তব্যই বুঝাইয়া দেয় যে, অপরাধের অপেক্ষা অপরাধের অভিযোগের প্রতি তিনি অধিক অসহিষ্ণু। তিনি ও তাঁহার দলের নেতারা বার বার নির্যাতিতার পরিবারকে চাকরি, টাকা দিয়া ‘ক্ষতিপূরণ’ করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। কিন্তু ওই এলাকায় দ্বিতীয়বার নির্যাতন ঘটিবে না, এমন প্রতিশ্রুতি কেহ দেন নাই। কামদুনির তরুণীটির পরিবার সরকারি সাহায্য প্রত্যাখ্যান করিয়া বুঝাইয়াছেন যে, রাজনৈতিক কৌশলে প্রশাসনিক গাফিলতি ঢাকিবার দিন শেষ হইয়াছে। এনসিআরবি-র পরিসংখ্যান লইয়া তর্ক যদি বা চলে, কামদুনি-কাণ্ডের এই বার্তা লইয়া সন্দেহের অবকাশ নাই। |