|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
শিল্পী চেতনায় ফুটে ওঠা অন্য এক প্রবহমান জীবন |
আইসিসিআর-এ অনুষ্ঠিত হল একটি সম্মেলক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ |
গত কয়েক বছর যাবৎ ধীরাজ চৌধুরী প্রতি বছর তাঁর ছবির পূর্বাপর প্রদর্শনী করছেন। কিন্তু তিনি শুধু নিজের ছবিই দেখতে চান না। সঙ্গে তুলে ধরেন বাংলার সমকালীন চিত্র-ভাস্কর্যের একটি রূপরেখাও। প্রদর্শনীটি এ কারণে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ বছর প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে আইসিসিআর-এর চারটি গ্যালারি জুড়ে। তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত ছিল প্রদর্শনী। ধীরাজ চৌধুরীর নিজের কাজ, আমন্ত্রিত শিল্পীদের ছবি ও ভাস্কর্য এবং সহজ মূল্যে বিক্রয়যোগ্য প্রতিষ্ঠিত ও নবীন শিল্পীদের রচনা।
ধীরাজ তাঁর নিজের ছবিকে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ভিত্তিতে উপস্থাপিত করেছেন। নাম দিয়েছেন ‘কলকাতা থ্রু দ্য আই অব ধীরাজ চৌধুরী’। একটিতে তাঁর ছাত্রজীবনে ও তরুণ বয়সে দেখা কলকাতা। অন্যটিতে বাংলার বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকের লেখায় উদ্ভাসিত কলকাতার বাক্-প্রতিমার চিত্রায়ণ।
১৯৫৫ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের ছাত্র ছিলেন। কলকাতার সঙ্গে তখন তাঁর নিবিড় সম্পর্ক ছিল। কলকাতার নিসর্গ ও জীবনের যে অজস্র ছবি এঁকেছেন তিনি সেই সময়, তার কিছু নিদর্শন এই প্রদর্শনীতে ছিল। কলকাতার জিপিও, আউট্রামঘাট বা কফিহাউসের দৃশ্যাবলিতে দৃশ্যকে বাইরে থেকে দেখা এবং দৃশ্যের ভিতর নিজের অনুভূতিকে সঞ্চারিত করে দেওয়া এই দু’টি দৃষ্টিকোণের সমন্বয় ঘটেছে সুন্দর ভাবে। এই বৈশিষ্ট্যকেই পরবর্তী কালে তিনি আরও পরিশীলিত করেছেন। প্রতিচ্ছায়াবাদ ও অভিব্যক্তিবাদের সমন্বয় ও দ্বান্দ্বিকতা থেকে পরিণত পর্বে গড়ে তুলেছেন তাঁর নিজস্ব রূপভঙ্গি। প্রবহমান জীবন ও বাস্তবতার সঙ্গে নিবিড় সংযোগ তাঁর শিল্পী চেতনার একটি বৈশিষ্ট্য। সেই বাস্তবের অন্তর্লীন শূন্যতা তাঁকে তাড়িত করেছে। এরই প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর আঙ্গিকে। কলকাতা তথা বাংলার বিভিন্ন কবি ও মনীষীর ভাবনা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে এই আলোর সন্ধানে
‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে
তবে একলা চলো রে’
কবির এই বাণীর সাম্প্রতিক একটি চিত্রায়ণ, সেই আলোর অভীপ্সারই ইঙ্গিত।
|
|
শিল্পী: ধীরাজ চৌধুরী |
এই প্রদর্শনীর দ্বিতীয় অধ্যায় নির্বাচিত শিল্পীদের কাজের সম্মেলক। এই প্রদর্শনীটি ‘সেলিব্রেশন ২০১৩ কলকাতা’ এই শিরোনামের অন্তর্গত। কিন্তু খুব কম কাজই কলকাতা কেন্দ্রিক। অনেক শিল্পী হয়তো প্রত্যক্ষে কলকাতার কথা বলেননি। কিন্তু পরোক্ষে আভাসিত হয়েছে শহরের বাস্তব। প্রদর্শনীটি কোনও কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। ফলে একটু অগোছালো, অভিমুখহীন। তবু অনেক শিল্পীর কাজই এই সময়ের তমিস্রা ও অন্তর্লীন প্রজ্ঞার উপর আলোকপাত করে।
চিত্রভানু মজুমদার মৃত্যুর বিভীষিকাকে ধরতে চেয়েছেন তাঁর একটি ছবিতে। একটি মানব করোটি হাসছে। তার চক্ষুর কোটরে বীভৎস অন্ধকার। চিত্রভানু তাঁর সাম্প্রতিক ছবিতে অনেক সময়ই তমসাকে বিমূর্ততায় ধরতে চান। বাস্তবের নিষ্ঠুরতা তাঁকে হয়তো আরও প্রাজ্ঞ করেছে। ছত্রপতি দত্তের একটি ছবিও অনেকটা সমধর্মী। ফুটে আছে একটি সূর্যমুখী। তার দিকে তাকিয়ে আছে এক মানবী। মুখের ভিতরে তাঁর দাঁতের কঙ্কালগুলি প্রকট হয়ে উঠেছে। জয়শ্রী চক্রবর্তী বিপরীত মেরুর এক প্রজ্ঞাকে তুলে ধরেছেন। সমস্ত প্রকৃতি জুড়ে আবর্ত চলছে। তারই ভিতর ফুটে উঠেছে ফুল। ভেসে উঠছে প্রশান্ত এক মুখ। এই প্রজ্ঞার এক পরম্পরাগত রূপ তুলে ধরেছেন ব্রতীন খান। প্রস্ফুটিত স্বর্ণাভ ফুলের প্রেক্ষাপটে শ্রীকৃষ্ণ বাঁশি বাজাচ্ছে। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে যে মানবী, সে কি রাধা? আসলে রাধা ছাড়া কৃষ্ণ হয় না।
শেখর রায়ের ছবিতেও আর এক রকম কৃষ্ণকে দেখি। অনেক আধুনিক প্রকরণে সে নিজের মধ্যে ধারণ করে আছে সাম্প্রতিকের স্তব্ধ সংশয়। আদিত্য বসাকের ছবিতে প্রাক-ইতিহাস মিশে যায় আজকের ইতিবৃত্তে। অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর কাজ সমৃদ্ধ করেছে প্রদর্শনীকে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন রবীন মণ্ডল, গণেশ হালুই, সুনীল দাস, লালুপ্রসাদ সাউ, অনিতা রায়চৌধুরী, শ্যামশ্রী বসু, অমিতাভ সেনগুপ্ত প্রমুখ। ভাস্কর্যে নিরঞ্জন প্রধান শব্দদূষণের যন্ত্রণাকে তুলে ধরেছেন উচ্চকিত ভাবে। বিমান দাসের কাজে রয়েছে ধ্রুপদী আধ্যাত্মিকতা। অন্য রকম এক তন্ময়তা উদ্ভাসিত হয়েছে বিমল কুণ্ডুর ‘মা ও শিশু’ রূপারোপে। কালীঘাটের পটের ছবি থেকে শাবক-মুখে বিড়ালটিকে তুলে এনেছেন তাপস সরকার। পঙ্কজ পাওয়ার, তারক গড়াই, শঙ্কর ঘোষ, ঋষি বড়ুয়া, সুতনু চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পী ভাস্কর্যের নানা দিগন্তকে মেলে ধরেছেন। |
|
|
|
|
|