রেললাইনে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছেন বছর পঞ্চাশের প্রৌঢ়। পাশে পড়ে কাটা পা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সারা শরীর। ভিড় করে দেখছেন অনেকেই। কিন্তু সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে আসছেন না।
প্রায় আধ ঘণ্টা পরে লোকমুখে খবর পেয়ে কয়েক জন সহকর্মী ঘটনাস্থলে এসে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক গুপীনাথ ভাণ্ডারীকে। কাটা পা-টাও হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। যদিও শেষ পর্যন্ত তা আর জোড়া লাগানো যায়নি। গুরুতর জখম অবস্থায় বাইপাসের ধারে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ওই শিক্ষক।
শুক্রবার সকাল সাড়ে ১১টায় যাদবপুর পালবাজার লেভেল ক্রসিংয়ের এই ঘটনায় পথচলতি মানুষের এমন ভূমিকায় বিস্মিত যাদবপুরের শিক্ষকেরা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য সিদ্ধার্থ দত্ত বলেন, “কখনও শুনিনি, এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে, কিন্তু কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি। এর আগে সব সময় দেখেছি, কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে স্থানীয় মানুষই আগে সাহায্য করেছেন। গুপীনাথবাবুর ঘটনায় আমরা বিস্মিত।” বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিকেরা সময়মতো ঘটনাস্থলে না পৌঁছলে যে কী হত, তা ভেবে শিউরে উঠছেন গুপীনাথবাবুর সহকর্মীরা। |
এই ঘটনাটি তাই ফের প্রশ্ন তুলে দিয়েছেএই শহরের মানুষ কি ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছেন? সহ-নাগরিক বিপদে পড়লেও কি হাত বাড়াতে আজকাল এগিয়ে আসছেন না কেউ?
ঘটনার বিবরণ শুনে শিউরে উঠে সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য বলছেন, “এই শহরের মানুষ পাশে দাঁড়াতে ভুলে গিয়েছেন। ভুলে গিয়েছেন প্রতিবাদ করতেও। এতটাই যদি অমানবিকতা, তবে কীসের মানুষ? ‘দহন’-এর ঝিনুক একা ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে মার খেয়েছিল। এখনও ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে মারধর তো বটেই, এমনকী মৃত্যুর ঘটনাও হয়। তাই এ ধরনের ঘটনায় মানুষ এগোতে চান না। কিন্তু দুর্ঘটনায় তো তার আশঙ্কা নেই। তা হলে লোকে এগোবে না কেন?”
সমাজতাত্ত্বিক অভিজিৎ মিত্রও বলছেন, “সত্যিই পাল্টে গিয়েছেন এ শহরের মানুষ। ফাস্ট লাইফের সঙ্গে তাল মেলাতে মেলাতে নিজেকে নিয়ে এতটাই তাঁদের ব্যস্ততা যে, পাশের মানুষটাকে নিয়েও সচেতন নন তাঁরা। রাস্তায় কাউকে এ ভাবে পড়ে থাকতে দেখলে চোখ ফিরিয়ে নেওয়াটাই তাঁদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কারণ তাকালেই একটা দায়িত্ব বর্তাবে। সেই দায়িত্বটাকে এড়াতেই তাঁদের অনীহা। সকলেই বোধ হয় ভাবে অন্য কেউ করুক।”
গুপীনাথবাবুকে প্রথমে যে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে দাঁড়িয়ে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এক যুবক বলেন, “এ সব ঘটনায় এগিয়ে যাওয়াটাও সমস্যা। পুলিশের ঝামেলায় জড়ানোর ভয়েই প্রথমে এগোতে সাহস হয়নি।”
বলছেন অভিজিৎবাবুও— “এটা ঠিক যে দুর্ঘটনাগ্রস্তকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে আগে থানা-পুলিশের কাছে দৌড়োদৌড়ি করতে হবে, তার পরে খাতা-কলম নিয়ে বসতে হবে। এই সব হ্যাপা এড়াতেই মানুষ আজকাল এগোতে চান না কারও বিপদে। কারও অত সময়ও নেই। দুর্ঘটনা বা প্রাণসংশয়ের মতো ঘটনার ক্ষেত্রে অন্তত হাসপাতাল, থানা-পুলিশের নিয়মকানুনগুলো বদলানোটা খুব জরুরি।”
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, ঢাকুরিয়ার বাসিন্দা গুপীনাথবাবু লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক শিক্ষাকর্মী বলেন, “যাদবপুর স্টেশনের দিকে যেতে গিয়ে দেখি ভিড়। সামনে গিয়ে দেখলাম গুপীনাথবাবু উপুড় হয়ে পড়ে। পা-টা কাটা। অনেকে দাঁড়িয়ে দেখছেন, কেউ এগিয়ে আসছেন না।” ওই শিক্ষাকর্মী-সহ আরও কয়েক জন দৃশ্যটি দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে খবর দেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান কয়েক জন আধিকারিক।
আধিকারিকদের দাবি, সাধারণ মানুষের তো বটেই, রেল পুলিশেরও সাহায্য পাননি তাঁরা। পুলিশের দেখাই মেলেনি। যদিও এডিজি (রেল) অমরকান্তি সরকারের দাবি, “যাদবপুর রেলপুলিশ কর্মীরাই ওই শিক্ষককে তুলে ট্যাক্সি করে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করেছেন।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিকেরা অবশ্য জানান, গুপীনাথবাবুকে পাঁজাকোলা করে ট্যাক্সিতে তোলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্স অফিসার গৌরকৃষ্ণ পট্টনায়ক। রেল পুলিশের দেখা মেলে বাইপাসের বেসরকারি হাসপাতালে। আধিকারিকদের এক জন বলেন, “সাহায্য না করে ওঁরা বোধহয় আমাদের পিছু নিয়েছিলেন!”
কী ভাবে উদ্ধার করা হল গুপীনাথবাবুকে? গৌরকৃষ্ণবাবু বলেন, “ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখি, পুলিশের ভয়ে কেউ এগোতেই চাইছেন না। আমি গুপীনাথবাবুকে তুলে নিই। তখন কেউ কেউ এগিয়ে আসেন। এত রক্ত বেরোচ্ছিল যে আমার সারা শরীর রক্তে ভিজে যায়। পরে ট্যাক্সিতে বসে যখন ওঁর মাথাটা কোলে রাখলাম তখন বুঝি যে মাথা থেকেও অনেক রক্ত বেরোচ্ছে।” প্রথমে যাদবপুরের একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে, সেখান থেকে বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ওই শিক্ষককে।
রেল অবশ্য ঘটনার দায় ঘুরিয়ে গুপীনাথবাবুর ঘাড়েই চাপিয়েছে। পূর্ব রেল সূত্রের খবর, রেললাইনের উপরে উড়ালপুল তৈরি হওয়ার পর থেকে পালবাজারের ওই লেভেল ক্রসিংটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেখান দিয়ে পারাপার করা বেআইনি। রেললাইনের দু’ধারে একটু ফাঁক রেখে লোহার রেলিং বসানো আছে। সেখান দিয়ে যানচলাচল করতে পারে না। কিন্তু ওই ফাঁক গলে রোজ যাতায়াত করেন অনেকেই। সে ভাবে ঝুঁকি নিয়েই গুপীনাথবাবুও লাইন পেরোতে গিয়েছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আধিকারিক জানান, গুপীনাথবাবুর কাটা পায়ের অনেকটা থেঁতলে গিয়েছে। তাই সেটি আর জোড়া লাগানো যায়নি। ওই আধিকারিক বলেন, “চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, মাথায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে। খুলিতেও আঘাত ছিল। প্রাথমিক চিকিৎসা করে ওঁকে আইটিইউ-তে রাখা হয়েছে।” |