এলোমেলো অবস্থা থেকে ঘর গুছিয়ে নরেন্দ্র মোদীকে সামনে রেখে লোকসভা ভোটের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে বিজেপি। তৃণমূলের সঙ্গে জোট না হলে এ রাজ্যে সেই ভোটে একাই লড়তে হবে তাদের। সে জন্য তারা কতটা প্রস্তুত, আসন্ন পঞ্চায়েত ভোট তার শেষ মহড়ার সুযোগ। এমন যখন পরিস্থিতি, সেই সময়ে বর্ধমানে বিজেপি-র ‘শক্ত ঘাঁটি’ হিসেবে পরিচিত পূর্বস্থলী এলাকায় ধস নেমেছে তাদের জনভিত্তিতে। গত বিধানসভা ভোটের হিসেব এবং গত দু’বছরে ওই এলাকায় তাদের নেতা-কর্মীদের দলত্যাগের পরিসংখ্যান থেকে অন্তত সেই তথ্যই মিলছে।
গত পঞ্চায়েত ভোটে পূর্বস্থলীতে তৃণমূলের সঙ্গে জোট করে লড়াই করেছিল বিজেপি। পূর্বস্থলী ২ ব্লকে কিছু জায়গায় সেই জোটে সামিল হয়েছিল কংগ্রেসও। দু’টি ব্লকের মোট ১৭টি পঞ্চায়েতের দশটিতেই ক্ষমতা দখল করে জোট। এর মধ্যে পূর্বস্থলী ১ ব্লকের নসরতপুর এবং পূর্বস্থলী ২ ব্লকের কালেখাঁতলা ১ ও মুকসিমপাড়া পঞ্চায়েতে তৃণমূলের থেকেও বিজেপি-র পঞ্চায়েত সদস্য ছিল বেশি। কিন্তু মাস ছয়েক গড়াতে না গড়াতেই ফাটল ধরে জোটে। নানা বিষয়ে মতানৈক্য শুরু হয়। তার জেরে বিজেপি ছেড়ে অনেকেই তৃণমূলে যোগ দেন দুই ব্লকেই।
গত বিধানসভা ভোটে একা লড়াই করে পূর্বস্থলীর দু’টি আসনেই ভোট কমে বিজেপি-র। পূর্বস্থলী উত্তর কেন্দ্র, যার অধিকাংশ এলাকা পূর্বস্থলী ২ ব্লকের অন্তর্গত, সেখানে ২০০৬ সালে প্রায় সাড়ে ১৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বিজেপি। ২০১১-তে তা নেমে দাঁড়ায় ১০.৩২ শতাংশে। পূর্বস্থলী দক্ষিণ কেন্দ্র, যার বেশিরভাগ অংশ পূর্বস্থলী ১ ব্লকে পড়ে, সেখানে ভোটের হার ৮.৬ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়ায় ৬.২ শতাংশে। এর পরেও বিজেপি-র বেশ কিছু নেতা-কর্মী তৃণমূলে যোগ দেন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন পঞ্চায়েতের প্রধান-উপপ্রধানও।
এ বার পূর্বস্থলীর দু’টি ব্লকে পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির সব আসনে প্রার্থীও দিতে পারেনি বিজেপি। পূর্বস্থলী (উত্তর) কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, “এর থেকেই প্রমাণ হয়, ওদের শক্তি কতটা ক্ষীণ হয়ে গিয়েছে। বিজেপি আর এ বার লড়াইয়ের ময়দানে নেই। ২০০৮-এ জোট যত আসন পেয়েছিল, এ বার তৃণমূল একাই তার থেকে বেশি পাবে।” বছরখানেক আগে পূর্বস্থলী ২ ব্লকে বিজেপি থেকে তৃণমূলে যোগ দেওয়া নেতা তাপস দে জানান, গত বার বিজেপি থেকে দু’টি পঞ্চায়েতের প্রধান ও চারটি পঞ্চায়েতের উপপ্রধান নির্বাচিত হন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে এক জন প্রধান ও তিন উপপ্রধান ইতিমধ্যে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন।
পঞ্চায়েত সমিতির খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ বিকাশ বসাক, নসরতপুর পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান প্রদীপ বসাক-সহ পূর্বস্থলী ১ ব্লকের অনেকেও বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে গিয়েছেন। যে নসরতপুর পঞ্চায়েতে বিজেপি-র শক্তি ছিল সবচেয়ে বেশি, গত বিধানসভা ভোটে সেখানকার সব ক’টি গ্রাম সংসদেই এগিয়েছিলেন তৃণমূলের প্রার্থী। যদিও বিজেপি নেতৃত্ব এ সবকে পাত্তা দিতে নারাজ। তাঁদের দাবি, যাঁরা দল ছেড়েছেন তাঁদের বেশিরভাগই ছিলেন উচ্ছৃঙ্খল। তাই তাঁরা ছেড়ে যাওয়া দলের পক্ষে ভাল হয়েছে। বিজেপি-র জেলা সভাপতি রাজীব ভৌমিকের বক্তব্য, “অনেকে আবার আমাদের দলে যোগ দিয়েছেন। তাঁরা এ বার প্রার্থীও হয়েছেন। একক ভাবে লড়াই করেও এ বার আমরা ভাল ফল করব।” সব আসনে প্রার্থী দিতে না পারার কারণ হিসেবে তাঁর দাবি, কিছু এলাকায় সংগঠনে খামতি রয়েছে। বিধানসভা নির্বাচনে ভোট কমা প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “ওই ভোটের আঙ্গিক ছিল আলাদা। বাম জমানারা অবসান ঘটাতে মানুষ তৃণমূলকে ভোট দিয়েছিলেন। পঞ্চায়েত ভোটে কিন্তু সেই হিসেব খাটবে না।” সিপিএমের পূর্বস্থলী জোনাল সম্পাদক সুব্রত ভাওয়াল বলছেন, “গত বার জোটের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল। এ বার তা হচ্ছে না, খানিকটা সুবিধা হবেই।”
শুধু পূর্বস্থলী নয়, পঞ্চায়েত ভোটে প্রার্থী দেওয়ার ব্যাপারে জেলা জুড়েই বেশ কোণঠাসা পরিস্থিতি বিজেপি-র। কালনা মহকুমার পাঁচটি ব্লকে তবু তারা প্রার্থী দিতে পেরেছে, কিন্তু বাকি অংশে তাদের পরিস্থিতি তথৈবচ। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, মোট ৪০৬৭ পঞ্চায়েত আসনের মধ্যে ৫৬৯টিতে প্রার্থী দিয়েছে বিজেপি। এর মধ্যে কালনা মহকুমাতেই রয়েছেন ৩২৬ জন। আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে জামুড়িয়া এবং দুর্গাপুর-ফরিদপুর ব্লকের কোনও পঞ্চায়েত আসনেই বিজেপি-র প্রার্থী নেই। পাণ্ডবেশ্বরে ১১২টির মধ্যে তাদের প্রার্থী রয়েছে মাত্র দু’টি পঞ্চায়েত আসনে। গ্রামীণ এলাকায় কেতুগ্রাম ১ ব্লকে কোনও পঞ্চায়েত আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি বিজেপি। অথচ, গত বিধানসভা ভোটে কেতুগ্রামে প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল তারা। ওই ব্লকে অবশ্য ‘সন্ত্রাসের’ কারণে বিরোধী দলের প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা দিতে পারেননি বলে আগেই অভিযোগ উঠেছে। সেখানকার ১১৭টি পঞ্চায়েত আসনের ৮৮টিতে তৃণমূল ছাড়া অন্য কারও প্রার্থী নেই। রায়না ২ ব্লকেও বিজেপি পঞ্চায়েতে প্রার্থী দিতে পারেনি।
বিজেপি-র আসানসোল জেলা সভাপতি রামকুমার সিংহের যদিও দাবি, “পঞ্চায়েতের ত্রিস্তরে গত বার আমরা শিল্পাঞ্চলে মোট ৪০ জন প্রার্থী দিতে পেরেছিলাম। এ বার সেখানে ৭৬ জন প্রার্থী দিয়েছি। সেই অনুযায়ী, আমাদের অগ্রগতিই হয়েছে।”
|
(সহ-প্রতিবেদন: নীলোৎপল রায়চৌধুরী) |