দুর্ঘটনা, অথবা অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে তিন দিনের মধ্যে ময়না-তদন্তের রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। খাতায়-কলমে এটা সম্ভব হলেও পরিকাঠামো ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের অভাবে কাজটা করে দেখানো কার্যত অসম্ভব বলে মনে করছে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর থেকে চিকিৎসক মহল। শুধু ভিসেরা রিপোর্ট না-পাওয়ায় গত পাঁচ বছরে ৭০০০-এর মতো ময়না-তদন্তের রিপোর্ট বকেয়া পড়ে।
একটি জনস্বার্থ মামলার রায় দিতে গিয়ে মঙ্গলবার হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ওই নির্দেশ দেয়। আবেদনকারীর অভিযোগ ছিল, ময়না-তদন্তের রিপোর্ট পেতে দেরি হওয়ায় পুলিশি-তদন্ত এগোয় না, মৃতের পরিবার বিচার পায় না। বহু ক্ষেত্রে অপরাধীরা ছাড় পেয়ে যায়। অভিযোগ যে সত্য, প্রশাসনও মানছে। এক স্বাস্থ্য কর্তার কথা, “আদালত বললেও রাতারাতি কোনও পরিবর্তন হবে না। নির্দেশ পালনের মতো পরিকাঠামোই নেই।”
খুন-জখম ছাড়াও যে কোনও দুর্ঘটনা, সাপে কাটা, ইলেকট্রিক শক বা অজানা কারণে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আনার পথে মৃত্যু হলেও ময়না-তদন্ত করা হয়। এ জন্য প্রতি জেলায় একটি করে মর্গ রয়েছে। মর্গ রয়েছে বেশ কিছু মহকুমাতেও। কলকাতায় মর্গ রয়েছে ৫টি। প্রতিটি মর্গে দিনে ৮-১০টি ময়না-তদন্ত হয়। কলকাতার মর্গগুলিতে মেডিক্যাল কলেজগুলির ফরেন্সিক মেডিসিনের চিকিৎসকেরা ময়না-তদন্ত করেন। জেলা-মহকুমায় আলাদা চিকিৎসক নেই। হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকেরাই ময়না-তদন্ত করেন।
পরিস্থিতি কতটা কঠিন তা বোঝাতে ফরেন্সিক মেডিসিনের এক বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসক জানান, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ৬৫টি থানার সমস্ত ময়না-তদন্ত মোমিনপুরে কাঁটাপুকুর মর্গে করা হয়। তিন জন ডাক্তার এবং ৮-১০ জন ডোম কাজটা করেন। এই ডাক্তাররাই রিপোর্ট নিয়ে আদালতে সাক্ষ্য দিতে যান। তাই কাজ ব্যাহত হয়। আবার বিষ খেয়ে মৃত্যুর ঘটনায় মৃতের ভিসেরা পাঠানো হয় ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে। সেই রিপোর্ট পেলে ময়না-তদন্তের রিপোর্ট চূড়ান্ত করা হয়। অনেক সময় ভিসেরা রিপোর্ট পেতে দেরি হয়। আটকে যায় রিপোর্ট তৈরির কাজ। তবে কাকদ্বীপে একটি মর্গ হয়েছে। তা চালু হলে কাঁটাপুকুরের উপর চাপ কমবে।
স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “ময়না-তদন্তের জন্য ডাক্তার দেওয়ার কথা স্বরাষ্ট্র দফতরের। তারা তা দিতে পারছে না বলেই ময়না-তদন্তের জন্য হাসপাতাল থেকে আমাদের ডাক্তার দিতে হয়।” শতপথী বলেন, পরিকাঠামোর অভাবের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র দফতরই বলতে পারে। তবে হাইকোর্ট নিদের্শ দিলে রাজ্যকে মানতেই হবে।
পরিকাঠামো ও প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের বন্দোবস্ত করা গেলে যে তিন দিনে রিপোর্ট দেওয়া যায়, তা মানেন চিকিৎসকেরা। এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেন্সিক মেডিসিনের প্রাক্তন প্রধান চিকিৎসক আর এন কর্মকারের কথায়, “রিপোর্ট দিতে তিন দিনের বেশি সময় লাগার কথা নয়। তবে জেলাগুলিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব।” ফরেন্সিক মেডিসিনের একটি ‘ডিপ্লোমা কোর্স’ ফের চালু করার উপর জোর দিয়েছেন তিনি। ফরেন্সিক মেডিসিনের ওই বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসক জানান, ইংল্যান্ডে এক জন ডাক্তার ছ’ঘন্টায় তিনটি ময়না-তদন্ত করেন। এখানে দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টের মধ্যে গড়ে দশটি ময়না-তদন্ত করা হয়। তাঁর মন্তব্য, “কোর্টের নির্দেশ ন্যায্য। কিন্তু পরিকাঠামোর অভাবও সমান সত্যি।”
|