শাসক দলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগে বাজার সরগরম! তার আড়ালেই নিজেদের দল ও সংগঠনের জন্য এ বারের পঞ্চায়েত ভোটে বড়সড় পরীক্ষা সেরে নেওয়ার
কাজে হাত দিয়েছে সিপিএম। সেই সঙ্গে বামফ্রন্টও।
বিরোধী আসনে যাওয়ার পরে এ বারই প্রথম পঞ্চায়েত ভোট মোকাবিলা করতে নেমেছে সিপিএম। এবং কঠিন লড়াইয়ের ময়দানে এ বার তাদের ভরসা তাজা মুখ! ভোটের প্রস্তুতি-পর্বেই জেলা কমিটিগুলির প্রতি আলিমুদ্দিনের নির্দেশ ছিল, সামগ্রিক ভাবে পঞ্চায়েতের তিন স্তরে অন্তত ৫০% নতুন প্রার্থী বাছাই করতে হবে। প্রথম দফার ভোটের জন্য
মনোনয়ন ও প্রত্যাহারের পর্ব ইতিমধ্যেই শেষ।
বাকি দুই দফার জন্য ওই প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছনোর পরে আলিমুদ্দিনের হিসাব, ১৭টি জেলায় বামেদের মোট প্রার্থীর প্রায় ৭০%-ই নতুন মুখ। কতগুলি আসনে শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, তা নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তা রয়েছে অবশ্যই। কিন্তু সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্ব মনে
করছেন, গ্রামে-গঞ্জে স্থানীয় স্তরে যাঁদের ভাবমূর্তি নিয়ে জনতার মনে প্রশ্ন ছিল, তাঁদের বদলে ফেলার এটাই সেরা মওকা।
উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গ মিলিয়ে এখন ১৭টির মধ্যে ১৪টিরই জেলা পরিষদে ক্ষমতায় রয়েছে বামেরা। ক্ষমতার এই সমীকরণ এ বারের ভোটের পরে যে বিলকুল বদলে যাবে, বিলক্ষণ জানেন সিপিএম নেতৃত্ব। এই নির্বাচনকে তাঁরা কাজে লাগাতে চাইছেন লোকসভা ভোটের আগে সংগঠনকে প্রয়োজনীয় ঝাঁকুনি দেওয়ার লক্ষ্যে। বেশ কয়েকটি জেলার সভাধিপতি-সহ জেলা পরিষদের একগুচ্ছ প্রার্থী এ বার বাদ পড়ছেন। কোনও কোনও জেলায় (যেমন, হাওড়া) প্রায় গোটা জেলা পরিষদের প্রার্থী তালিকাই একেবারে আনকোরা! পাল্লা দিয়ে নতুন মুখ আনা হচ্ছে পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরেও। গৌতম দেবের
উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিপিএম যেমন প্রার্থী-তালিকা থেকে শুরু করে পঞ্চায়েতে জেলা পার্টির ‘কন্ট্রোল রুম’ গোটা ‘মেশিনারি’তেই গুরুত্ব দিয়েছে নতুন রক্তকে! ক্ষমতায় থাকার ফলে জেলা পরিষদ থেকে গ্রাম পঞ্চায়েত পর্যন্ত বহু ক্ষেত্রে স্থানীয় বাম জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে কোথাও দুর্নীতি, কোথাও দাদাগিরির অভিযোগ এনেছেন স্থানীয় মানুষই। সেই অস্বচ্ছ ভাবমূর্তিই এ বার বিসর্জন দিতে সচেষ্ট হয়েছে আলিমুদ্দিন।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। কেউ কেউ আবার সরাসরি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত না-হলেও হয়তো ঠিক ভাবে কাজ করতে পারেননি। কারও আবার ব্যবহারে গুরুতর সমস্যা ছিল। এই রকম অভিযোগ যাঁদের বিরুদ্ধে আছে, তাঁদের প্রার্থী করা যাবে না বলে জেলায় জেলায় পরিষ্কার নির্দেশ
ছিল। প্রথমে ঠিক হয়েছিল, ৫০%-ই নতুন মুখ হবে। এখন সেটা প্রায় ৭০%-এ গিয়ে দাঁড়াচ্ছে।” এমনিতেই সংরক্ষণের নানা বাধানিষেধের কারণে রোটেশন প্রথায় প্রতি বারই পঞ্চায়েতে বেশ কিছু আসনে নতুন মুখ আনা হয়। এ বার সেই অনুপাত সাম্প্রতিক নজির ছাপিয়ে যাচ্ছে।
বাম সূত্রেই অবশ্য ব্যাখ্যা মিলছে, ভাবমূর্তি পরিষ্কারের তাগিদের পাশাপাশিই পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতাও নতুন মুখ আনতে অনুঘটক হয়েছে। আরএসপি-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলছেন, “আগের
জয়ী প্রার্থীদের একটা অংশ এ বার হাওয়া বুঝে নিজেরাই আর দাঁড়াতে আগ্রহ দেখায়নি। সেটাও আখেরে আমাদের সাহায্য করেছে। আমরা ভবিষ্যতের কথা ভেবে নতুনদের সুযোগ দিতে পেরেছি।”
তবে নতুন মুখ এনেও সঙ্কটমুক্তি ঘটছে না বামেদের। ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের উদ্বেগ, “হুমকি, মারধর উপেক্ষা করেও যাঁরা শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন প্রত্যাহার না-করে লড়াইয়ে রয়ে গেলেন, তাঁদের একটা বড় অংশই এলাকায় ফিরতে পারছেন না। ফিরলেই তৃণমূলের হামলার মুখে পড়তে হবে। এঁরা এলাকার বাইরে থেকে যোগাযোগ করে জানতে চাইছেন, তাঁরা কী করবেন? কোনও নির্দিষ্ট আশ্বাস আমাদের কাছে নেই।” একই আশঙ্কা সিপিএমের বহু জেলা নেতারও। এক জেলা সম্পাদকের বক্তব্য, “কাগজে-কলমে প্রার্থী আছেন কিন্তু এলাকায় গিয়ে প্রচারে নামতে পারবেন না এই রকম অনেকেই আছেন। এঁদের জন্য কী করা যাবে, প্রতিনিয়ত আমাদের ভাবতে হচ্ছে!” ‘সন্ত্রাস’ মোকাবিলার এই ভাবনার মধ্যেও সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের যুক্তি, “জোর করে অনেক আসন তৃণমূল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতবে ঠিকই। তাতে ভবিষ্যতে ওদেরই বিপদ বাড়বে! কিন্তু মানুষ আমাদের দলে কিছু পরিবর্তন দেখতে চেয়েছিলেন। অনেক অসুবিধার মধ্যেও সেই পরিবর্তন আনার সংগ্রাম আমাদের চালিয়ে যেতেই হবে।” |