নিগ্রহ-তথ্য ঘিরে চাপান-উতোর
মহিলা আদালত মাত্র একটি, ভরসা তাই ফাস্ট ট্র্যাকই
হিলাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের দ্রুত বিচারের লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গে ৪৫টি মহিলা আদালত গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাজ্য। কথা ছিল, সে সব আদালতের বিচার থেকে শুরু করে অন্যান্য কাজ সামলাবেন মহিলারাই।
কিন্তু ঘটনা হল, এ পর্যন্ত মাত্র একটি মহিলা আদালত চালু করতে পেরেছে রাজ্য সরকার। মালদহে। রাজ্য প্রশাসনের তরফে বলা হয়েছে, আর্থিক টানাটানির দরুন প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়িত হতে সময় লাগছে। চলতি বছরের মধ্যে যাতে সব জেলায় অন্তত একটি করে মহিলা আদালত চালু করা যায়, আপাতত সেই চেষ্টা চলছে বলে সরকারি তরফের দাবি।
তবে প্রশাসনিক সূত্রে জানা যাচ্ছে, এ বছরের ২৩ জানুয়ারি মালদহে যে মহিলা আদালত চালু হয়েছে, এখনও সেখানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মী দেওয়া যায়নি। দু’জন বিচারক আছেন। কর্মী ন’জন। মহাকরণের এক কর্তার আশ্বাস, পুরোদস্তুর কাজকর্ম চালু করতে খুব তাড়াতাড়ি সেখানে আরও কর্মী দেওয়া হবে। তিনি এ-ও জানিয়েছেন, বর্তমানে রাজ্যে যে ৮৮টি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট রয়েছে, দ্রুত নিষ্পত্তির স্বার্থে সেখানেও নারী নিগ্রহের বিভিন্ন মামলা স্থানান্তরিত করা হচ্ছে। বারাসতের ধর্ষণ-মামলার বিচারও ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে হবে বলে বুধবার মহাকরণে জানিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র।
এ দিকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি)-র তথ্য বলছে, মহিলাদের উপরে অত্যাচারের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ দেশের শীর্ষে। ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী, ২০১১-য় এ রাজ্যে নারী নিগ্রহের মামলা দায়ের হয়েছিল ২৯,১৩৩টি, যার সুবাদে দেশে প্রথম স্থানে ছিল পশ্চিমবঙ্গ। ২০১২-য় সেটাই বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০,৯৪২-এ। এবং এ বারেও শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে পশ্চিমবঙ্গ। যদিও রাজ্য পুলিশের শীর্ষকর্তারা বিষয়টিকে এত সহজ ভাবে দেখতে নারাজ। কী বলছেন তাঁরা?
রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “সংবাদমাধ্যমে ওই তথ্যের ভুল ব্যাখ্যা হচ্ছে। আমাদের এখানে পণের কারণে বধূহত্যার ঘটনা অন্য রাজ্যের চেয়ে অনেক কম, গত এক বছরে মাত্র ৫৯৩টি। ধর্ষণের সংখ্যাও কমেছে। ২০১১-য় যেখানে ২,৩৬৩টি ধর্ষণের মামলা দায়ের হয়েছিল, ২০১২-য় তা কমে দাঁড়িয়েছে ২,০৪৬-এ।”
পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের উপরে অত্যাচার সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তি কত ‘দ্রুততা’র সঙ্গে হচ্ছে, তা জানাতে গিয়ে ডিজি বলেন, “মালদহে একটি আদিবাসী মেয়েকে ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় অভিযুক্তের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে মাত্র আট মাসে। ওই জেলারই বামনগোলা থানার একটি ধর্ষণ-মামলায় একই রায় শুনিয়েছেন বিচারক। উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ ও রায়গঞ্জে দু’টি পৃথক ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তের শাস্তি হয়েছে এক মাসের মধ্যে।” হলদিয়াতেও তিন অভিযুক্ত একই ভাবে শাস্তি পেয়েছে বলে দাবি করে নপরাজিতবাবুর মন্তব্য, “এই ঘটনাগুলোই প্রমাণ করে, মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ ঠেকাতে আমরা কতটা বদ্ধপরিকর।”
বস্তুত নিছক পরিসংখ্যান দিয়েই যে মহিলাদের উপরে অত্যাচার বৃদ্ধির বিশ্লেষণ করা উচিত নয়, সামাজিক স্বাধীনতাও যে অন্যতম প্রেক্ষাপট হওয়া উচিত, তা একাধিক বার এনসিআরবি’কে চিঠি লিখে জানিয়েছে রাজ্য সরকার। এ দিনের সাংবাদিক বৈঠকে প্রসঙ্গটি ফের উত্থাপন করেন ডিজি। “কেন আমরা এ কথা বলছি, তার সমর্থনে বেশ কিছু ব্যাখ্যা ওদের দিয়েছিলাম। কিন্তু ওরা তা মানেনি।” অভিযোগ করেন তিনি। মহাকরণের এক কর্তার বক্তব্য, “কেন্দ্রের আর্থিক সহায়তায় এ রাজ্যে ১৫১টি অস্থায়ী ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট চলত। ২০১১-র ১ এপ্রিল ইস্তক কেন্দ্র সে খাতে টাকা বন্ধ করে দেওয়ার পরে রাজ্য সরকারই খরচ-খরচা চালাচ্ছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে অস্থায়ী কোর্ট বন্ধ করে দিয়ে ৮৮টি স্থায়ী ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট খুলেছে রাজ্য সরকার।”
বিরোধীরা অবশ্য এ সব ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নয়। তাদের যুক্তি: ভাল-মন্দ বিচারে পরিসংখ্যানই মাপকাঠি, পরিস্থিতি কখনওই বিচার্য হতে পারে না। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন বলেন, “গত দু’বছরে এই সরকার অনেক কুকর্মে রাজ্যকে প্রথম স্থানে নিয়ে গিয়েছে। এটা নতুন ব্যাপার নয়।” সূর্যবাবুর মতে, থানায় গিয়ে অত্যাচারের অভিযোগ নথিভুক্ত করার ক্ষেত্রে মহিলাদের সামাজিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, এটা ঠিক। “কিন্তু কেউ সাহস করে মামলা দায়ের করার পরেও তো মুখ্যমন্ত্রী সাজানো ঘটনা বা ছোট ঘটনা বলছেন!”
আক্ষেপ করেন তিনি। তাঁর বক্তব্য: পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা গোটা দেশের মোট জনসংখ্যার সাড়ে সাত শতাংশের মতো। অথচ অপরাধের হার তেরো শতাংশের বেশি। পরিসংখ্যানটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করছে বলে জানিয়ে বিরোধী দলনেতার মন্তব্য, “দুর্ভাগ্যজনক যে, রাজ্য সরকার এতেও উদ্বিগ্ন নয়। আমরা হলে বলতাম, আমরা লজ্জিত, চিন্তিত। কিন্তু এখন পুলিশ-কর্তারা ইয়েস ম্যাম বলতে ব্যস্ত! তাঁরাও নেতাদের মতোই কথা বলছেন।”
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের অনুযোগ, “বাংলার মা-বোনেরা মমতাকে দু’হাত তুলে ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু ধর্ষিতার মায়ের চোখের জল এখন তাঁর মনে প্রভাব ফেলে না। তাই প্রশাসনও ধর্ষকদের গ্রেফতারে গড়িমসি দেখায়।” সরকারিপক্ষের কী অভিমত?
তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় অবশ্য মানেন না যে, রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলার সার্বিক অবনতি হয়েছে। এ দিন মধ্যশিক্ষা পর্ষদের তৃণমূলপন্থী কর্মচারীদের এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের সৌগতবাবু বলেন, “এক বছরে সামগ্রিক ভাবে অপরাধ বেড়ে গেলে বোঝা যাবে যে, রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হয়েছে। কিন্তু হিসেব বলছে, তা হয়নি। বরং উল্টো হয়েছে। এনসিআরবি-র সাম্প্রতিকতম রিপোর্ট দেখলেই তা বোঝা যাবে।” মমতা-সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও মনে করেন, রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলার সামগ্রিক অবনতি হয়নি। “মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যে পরিস্থিতি এমন জায়গায় নিয়ে এসেছেন যে, রাজ্যে অপরাধপ্রবণতা কমেছে। তবে নির্মূল করা যাবে কি না, জানি না। গেলে ভাল!” মন্তব্য ব্রাত্যবাবুর।

পুরনো খবর



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.