দিল্লির দামিনীর প্রতি সহমর্মিতার আন্দোলনে যাঁরা সামিল হয়েছিলেন, সেই বিশিষ্টজনেদের বিশেষ কাউকেই কামদুনি কাণ্ডে রাস্তায় নামতে দেখা যায়নি। অথচ সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রাম, রিজওয়ানুর কাণ্ড, শাহবাগ আন্দোলন, এমনকী অম্বিকেশ মহাপাত্রের ব্যঙ্গচিত্র কাণ্ড বা শিলাদিত্য চৌধুরীর গ্রেফতারি নিয়েও তাঁদের অনেকেই সংগঠিত আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তা হলে মহানগর থেকে ঢিল-ছোড়া দূরত্বে এক কলেজছাত্রী কিছু দুষ্কৃতীর বিকৃত কামনার শিকার হলে কি তাঁরা সে-ভাবে বিচলিত হন না?
কামদুনিতে কলেজছাত্রীকে গণধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় ছাত্র-যুব সমাজের নীরবতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠছে, তেমনই প্রশ্ন এই বিশিষ্টজনেদের মুখে কুলুপ আঁটা নিয়েও। এবং সেই বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়। তিনি মনে করেন, এটা একটা মানসিকতার সমস্যা। বিশিষ্টজনেদের এই আন্দোলন মূলত শহরকেন্দ্রিক। গ্রামের ঘটনা নিয়ে তাই আন্দোলন হয় না। যদিও তাঁর এই মন্তব্য নিয়ে একটি বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই বলছেন, সৌগতবাবু কামদুনিকে গ্রাম বললেও বাস্তবে তা মহানগরের প্রান্তে অবস্থিত।
ঠিক কী বলেছেন সৌগতবাবু?
বুধবার মধ্যশিক্ষা পর্ষদে এক অনুষ্ঠানের পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সৌগতবাবু বলেন, “এখনও গ্রামীণ এলাকার ঘটনার প্রতিবাদে সে-ভাবে আমি তথাকথিত বিদ্বজ্জনেদের দেখি না। এটা একটা মানসিকতার ব্যাপার। শহরে কোনও ঘটনা ঘটলে আমরা যে-ভাবে প্রতিবাদ করি, গ্রামে ঘটলে কি করি? আমার উত্তর হচ্ছে, না, করি না।” তাঁর মতে, রিজওয়ানুরের মৃত্যুর পরে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু সেটা পার্ক স্ট্রিটে, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের সামনে। দামিনী কাণ্ডও ছিল শহরকেন্দ্রিক।
কামদুনি কাণ্ডে বিচ্ছিন্ন কিছু আন্দোলন হচ্ছে। যেমন ফরওয়ার্ড ব্লক এ দিন শ্যামপুকুর থানা থেকে শ্যামবাজার মোড় পর্যন্ত মোমবাতি মিছিল করে। রফি আহমেদ কিদোয়াই রোড থেকে কিড স্ট্রিট পর্যন্ত মোমবাতি মিছিল করে ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রের যুব কংগ্রেস। শিল্পী-সাংস্কৃতিক কর্মী-বুদ্ধিজীবী মঞ্চের তরফে এক দল প্রতিনিধি গত রবিবার ওই ছাত্রীর বাড়িতে এবং বারাসত থানায় যান। সেই দলে ছিলেন সঙ্গীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়। এ ছাড়া বিশিষ্টজনেদের তরফে কোনও সংগঠিত উদ্যোগ সে-ভাবে চোখে পড়েনি এখনও।
এমন ঘটনার পরে শহরের বিশিষ্টজনেরা পথে নামছেন না কেন? তা হলে কি তাঁরা সত্যিই এলাকা-ভিত্তিক বিভাজনে বিশ্বাস করেন? |
বিশিষ্টজনেদের বক্তব্য, এমন কোনও বিভাজনে তাঁরা বিশ্বাস করেন না। কিন্তু যে-কোনও কারণেই হোক, কামদুনি নিয়ে আন্দোলন সংগঠিত হয়নি। তবে কোনও আন্দোলন হলে তাঁরা তাতে যোগ দেবেন। সঙ্গীতশিল্পী উষা উত্থুপ বলেন, “শহরে অপরাধ হলে আলাদা আর গ্রামে হলে আলাদা, এমনটা নয়। এমন ঘটনা ঘটলে প্রতিবাদ করতেই হবে। তবে আমার মতো অনেকেরই হয়তো জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় কিছু করে উঠতে পারেননি।”
যতটা হওয়া স্বাভাবিক ছিল, মিছিল-প্রতিবাদ যে সে-ভাবে হচ্ছে না, তা মেনে নিয়েছেন নাট্যকর্মী কৌশিক সেন। সৌগতবাবুর মন্তব্যের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, “পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষণের পরে শহরের বিশিষ্টদের অনেকেই পথে নামেননি। কিন্তু তাঁরাই দিল্লি ধর্ষণ কাণ্ডের পরে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, পার্ক স্ট্রিটের সঙ্গে দিল্লির প্রেক্ষিত আলাদা।” তাঁর মতে, শহরের বিশিষ্টদের একাংশ শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়াতেই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষেত্রে কিছুটা নীরব হয়ে পড়ছেন। একই সুরে চিত্রশিল্পী সমীর আইচ বলেন, “যাঁরা প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন না, তাঁদের কোনও ব্যক্তিগত স্বার্থ কাজ করছে।” তবে বিশিষ্টদের একটি অংশ এখনও সচেতন বলে মন্তব্য করেন কৌশিক। বলেন, “আমরা কয়েক জন শনিবারেই কামদুনির ওই ছাত্রীর বাড়িতে যাব।”
বিশিষ্টজনেদের নীরবতা নিয়ে মুখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ এলাকায় একের পর এক ধর্ষণের ঘটনায় উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন সৌগতবাবু। বারাসতের পরে সম্প্রতি নদিয়ার গেদেতে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে এক স্কুলছাত্রীকে। সৌগতবাবু বলেন, “মহিলা বা নারী যে ভোগের বস্তু নয়, সেটা মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া দরকার। তার জন্য জনচেতনা প্রসার, মানসিকতার পরিবর্তন এবং সামাজিক আন্দোলন দরকার। সম্প্রতি দু’টো ঘটনাই ঘটেছে গ্রামীণ এলাকায়।”
|