চাকরি, পড়া-চিকিৎসার খরচের প্রস্তাব খারিজ
সাহায্য নয় শাস্তি চাই, মমতাকে কামদুনি
দেখা করলেন। ক্ষতি পূরণের প্রতিশ্রুতি পেলেন। প্রত্যাখ্যান করে ফিরে গেলেন।
বাবা-মা মাঝপথ থেকেই ফিরে গিয়েছিলেন। বুধবার বারাসতের ধর্ষিত-নিহত তরুণীর দুই ভাই শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। মা-বাবার চিকিৎসার খরচ, দাদার চাকরি, ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ ঢালাও সাহায্যের আশ্বাস দেওয়া হয় তাঁদের। কিন্তু সে সবই ফিরিয়ে দিয়ে দুই ভাই বলে দিলেন, বোনের হত্যাকারীদের চরম শাস্তি ছাড়া আর কিছুই চাওয়ার নেই তাঁদের।
কামদুনির ওই ঘটনার পর থেকেই চাকরি-ক্ষতিপূরণ দিয়ে পরিবারের ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা শুরু করেছিলেন শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা। তাতে কাজ হয়নি। বরং মুখ্যমন্ত্রীকে কামদুনিতে আসার দাবি তুলেছিলেন গ্রামবাসীরা। বলেছিলেন, তাঁদের অভিযোগ শোনার কথাও। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যাননি।
শেষ পর্যন্ত ধর্ষিতার পরিবারকে মহাকরণে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দেন প্রশাসনিক কর্তারা। তা-ই নিয়ে দিনভর নাটক চলে বুধবার।
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য প্রথমে এ দিন বিকেল তিনটে নাগাদ ধর্ষিতা ছাত্রীর মা-বাবা-ভাইকে নিয়ে রওনা হয়েছিলেন পুলিশকর্তারা। রাস্তায় ওঁরা যখন জানতে পারেন, বাকি গ্রামবাসীদের মহাকরণে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না, তখন বেঁকে বসেন তাঁরা। অনেক বুঝিয়েও তাঁদের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যাওয়া যায়নি। দোলতলা পুলিশ লাইনে পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে পড়েন ওঁরা। ফোনে যোগাযোগ করেন গ্রামবাসীদের সঙ্গে। তার পরে অন্য একটি গাড়ি নিয়ে কামদুনি ফিরে যান তাঁরা।
কেন একা মহাকরণে যেতে চাইলেন না? ওই ছাত্রীর বাবা জানিয়েছেন, কামদুনির আন্দোলন শুধু তাদের পরিবারের নয়, গোটা গ্রামের। এলাকা জুড়েই নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। এ ছাড়াও ঘটনাস্থলে থানা এবং ওই ছাত্রীর নামে একটি কলেজ তৈরি-সহ ১১ দফা দাবি রয়েছে। এর পরেই ফের কামদুনিতে হাজির হয় পুলিশ। প্রশাসনের উচ্চমহল থেকে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলা হয়। নানা বাদানুবাদের পর বিকেল চারটে নাগাদ গ্রামবাসীদের নিয়ে কলকাতা রওনা হয় পুলিশ। এ বারে বাবা-মা আর আসেননি। গ্রামবাসীদের সঙ্গে ছিলেন ধর্ষিতার দুই ভাই।
এর মধ্যে নাটক চলতে থাকে মহাকরণেও। বিকেল তিনটে নাগাদ মন্ত্রিসভার বৈঠক মিনিট দশেকের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। তার পর থেকেই মহাকরণে ওই পরিবারের আসা নিয়ে নানা খবর আসতে থাকে। কখনও শোনা যায়, মাঝপথ থেকেই তাঁরা ফিরে চলে গিয়েছেন। কখনও আবার খবর ছড়ায়, মুখ্যমন্ত্রীকেই কামদুনি যাওয়ার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। পুলিশের বিভিন্ন কর্তাকে দেখা যায়, ওয়াকিটকিতে বারবার কথা বলতে। মহাকরণের সামনে পুলিশ ও চিত্রসাংবাদিকদের ভিড় দেখে পথচলতি মানুষও ভিড় জমায়।
কামদুনির নিহত ছাত্রীর স্বজনদের সঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। বুধবার মহাকরণে। ছবি: দেবাশিস রায়।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ দুটি ম্যাটাডরে করে কলকাতার বাবুঘাটে আসেন কামদুনির বাসিন্দারা। ওই ম্যাটাডরেই ছিলেন ধর্ষিতার দুই ভাইও। বাবুঘাটের সামনে আসতেই পুলিশবাহিনী কার্যত ম্যাটাডর দু’টিকে ঘিরে ফেলে। ম্যাটাডর আটকাতেই গ্রামবাসীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। গ্রামবাসীদের দাবি ছিল, সবাইকে ভিতরে ঢুকতে না দিলেও অন্তত মহাকরণের গেট পর্যন্ত যেতে দিতে হবে। কিন্তু পুলিশকর্তারা তাঁদের জানান, মহাকরণ এলাকায় সাত জনের বেশি লোককে যেতে দেওয়া হবে না। পুলিশের দাবি, প্রথমে গ্রামবাসীরা কথাটা মানতে চাননি। এর পর পুলিশ রাস্তায় কার্যত ব্যারিকেড করে ফেলে। শেষ পর্যন্ত ওই ধর্ষিতার দাদা ও ভাই সহ ছ’জনকে নিয়ে একটি গাড়ি মহাকরণে যায়। ম্যাটাডরে করে আসা বাকি লোকেরা রাস্তার ধারে বসে পড়েন।
সন্ধ্যা ছ’টা বাজতে পাঁচ মিনিটে গাড়ি এসে পৌঁছয় মহাকরণে। সংবাদমাধ্যমের উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যে কোনও রকমে দাদা, ভাই-সহ ছ’জন গ্রামবাসীকে পুলিশ ভিআইপি লিফট দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে নিয়ে যায়। রাজ্যের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য তার আগেই মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে চলে গিয়েছিলেন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র-সহ ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র, যুবকল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। মহাকরণের ভিতরে-বাইরে তখন পুলিশে-পুলিশে ছয়লাপ।
প্রায় এক ঘণ্টা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয় ওই ছ’জনের। প্রশাসন সূত্রের খবর, ধর্ষিতার দাদাকে সরকারি চাকরি, ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ, মা-বাবার চিকিৎসার খরচ বহন করার প্রতিশ্রুতি দেয় সরকার। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর সামনেই দুই ভাই সব সরকারি সাহায্য প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁদের দাবি, অভিযুক্তদের ফাঁসি চাই। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার তাঁদের সাহায্য নেওয়ার কথা বলা হয়। শেষ পর্যন্ত তাঁরা নিজেদের দাবিতে অনড় থাকেন।
সন্ধে সাতটা নাগাদ মুখ্যমন্ত্রীর ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন ওই ছ’জন। তাঁদের সঙ্গে যাতে সংবাদমাধ্যমের কেউ কথা বলতে না পারেন, সে জন্য ফের পুলিশি ঘেরাটোপে তাঁদের মহাকরণ থেকে বের করে গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়। পরে মহাকরণের বাইরে রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে ওঁরা খুশি। ওঁরা শুধু অপরাধীদের ফাঁসির দাবি করেছেন।”
মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যখন আলোচনা চলছে, সে সময় বাবুঘাটের কাছে রাস্তার ধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিলেন কামদুনির বাকি গ্রামবাসীরা। পুলিশ তাঁদের চা ও মিষ্টি খাওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু কেউ রাজি হননি। ওঁদের মধ্যে থেকে পার্থ ঘোষ নামে এক যুবক বলেন, “আমরা এখানে চা-মিষ্টি খেতে আসিনি। সবাই মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। আমাদের বাবুঘাটে আটকে দেওয়া হল।” রাস্তায় বসেই গ্রামবাসীরা নিজেদের ক্ষোভ উগরে দিতে থাকেন। সোমনাথ ঘোষ নামে আর এক যুবক বলেন, “গত শুক্রবার রাত থেকে আমাদের নাওয়া-খাওয়া নেই, ঘুম নেই। আমরা দোষীদের ফাঁসি চাই।” তাঁর প্রশ্ন, “শুক্রবার থেকে এ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী একবারের জন্যও আমাদের গ্রামে যাওয়ার সময় পেলেন না?” আর এক যুবক বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী তো কত রকম বিষয় নিয়ে ফেসবুকে লেখেন। কিন্তু আমাদের গ্রামের ঘটনা নিয়ে ফেসবুকে কোনও শোক প্রকাশও তো উনি করেননি।”
মুখ্যমন্ত্রী কেন ওই গ্রামে যাননি, তার একটা ব্যাখ্যা অবশ্য তিনি ধর্ষিতার দাদা-ভাইকে দিয়েছেন বলে মহাকরণ থেকে ফিরে কামদুনির প্রতিনিধিরা দাবি করেছেন। এ দিন যারা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান, তাঁদের এক জন সুকান্ত কয়াল বলেন, “বিষয়টির মধ্যে কোনও রাজনৈতিক রং লাগাতে চাননি বলেই তিনি কামদুনিতে যাননি বলে মুখ্যমন্ত্রী জানান।” সুকান্তবাবু জানান, মুখ্যমন্ত্রী ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের মাধ্যমে দ্রুত বিচার হওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। ঘটনাস্থলের কাছে একটি পুলিশ ফাঁড়ি করে দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ ছাড়াও ওই এলাকার সব উঁচু পাঁচিল ভেঙে ফেলা হবে এবং রাস্তায় বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এলাকার একটি মাধ্যমিক স্কুলকে উচ্চ মাধ্যমিকে উন্নীত করা হবে বলেও ওই প্রতিনিধিদের জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকও সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ঘটনাস্থলে ইতিমধ্যেই পুলিশ পিকেট বসে গিয়েছে। বিদ্যুতের খুঁটি পোঁতার কাজও শুরু হয়েছে।
সরকার সত্যিই প্রতিশ্রুতি পালন করছে কি না, সেটা দেখে তবেই আন্দোলন প্রত্যাহার করবে কামদুনি। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এলাকায় ফিরে সকলে এই সিদ্ধান্তই নিয়েছেন।


পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.