বিলিতি ময়দান
ধোনির ছেলেদের ডাকাবুকো মনোভাবের
আগুনে ফের আলোকিত ভারতীয় ক্রিকেট

নিবারের বার্মিংহ্যাম ডার্বি এখন নিছক ভারত-পাক মহাযুদ্ধ।
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মহাযুদ্ধ নয়।
ম্যাচ শেষে রবীন্দ্র জাডেজার সাংবাদিক সম্মেলনে যাওয়ার জন্য মাঠের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শুনলাম। নাসির হুসেন জিজ্ঞেস করছেন ডোয়েন ব্র্যাভোকে। তোমাদের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচটা তো কার্যত কোয়ার্টার ফাইনাল হয়ে গেল? তাঁর পাশে ওভাল গ্যালারি অবশ্য তখন স্পট ফিক্সিংয়ের মহাসঙ্কটের মধ্যে সেমিফাইনাল উত্থান নিয়ে আলাদা কিছু বলছে না। কেবল জাতীয় পতাকা নাড়িয়ে যাচ্ছে। ওভাল গ্যালারিতে তখন একই সঙ্গে এতগুলো জাতীয় পতাকা দেখা গেল যা ভারতের কোন ক্রিকেট স্টেডিয়ামে কবে দেখা গেছে, প্রচুর খেটে বার করতে হবে।
সাংবাদিক সম্মেলনে যে ব্র্যাভো এলেন, তাঁর মুখচোখ ৬৫ বল আগে শেষ হয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ হেরো ম্যাচের অধিনায়কের প্রতীক। বললেন, “জাড্ডু তো ভাল বল করেই। সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়ক ওকে ব্যাক করে যাচ্ছিল।” শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, ভারতীয় বোর্ডের তাঁকে কড়কানি দেওয়ার দিনে সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্যাপ্টেন পদবীটা ধোনিকে আহ্লাদিতই করত।
সুনীল নারিনের জন্য যেমন কেকেআর অপেক্ষা করে থাকে, তেমনি ওভালে অপেক্ষা করে ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু শুকনো উইকেট পেয়েও নারিন সেই ভেল্কি দেখাতে পারলেন না যা ইডেনে দেখিয়ে থাকেন। বরঞ্চ কানে দুল এবং পায়ে ট্যাটু সম্বলিত প্রথম ভারতীয় ক্রিকেটার শিখর ধবনের ব্যাটে যেন উড়েই গেলেন। টানা দ্বিতীয় ওয়ান ডে সেঞ্চুরি শিখরের। যাঁকে দেখে প্রাক্তন সব ভারত অধিনায়কেরা উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারছেন না। ‘গ্রুপ অব ডেথ’ বলা হচ্ছিল এই গ্রুপকে। সেখান থেকে একটা ম্যাচ বাকি থাকতে যে ভঙ্গিতে ধোনির ছেলেরা সেমিফাইনাল চলে গেল, তাতে মনে হচ্ছিল এদের দুঃসাহসী মনোভাবের মশালে আপাতত সব কিছু ধুয়েমুছে সাফ হয়ে থাকল। ব্র্যাভো যে ভঙ্গিতে কথা বলছিলেন, তাতে ভারতকে এক রকম ফেভারিটই চিহ্নিত করে দিলেন। বলে দিলেন, আইপিএল খেলে ভারতীয় ব্যাটিং এই দুঃসাহসী মনোভাবটা আয়ত্ত করেছে। শুনতে শুনতে আরও মনে পড়ছিল সকালের ভিড় ঠাসা ট্রেনটার কথা।
দুইয়ে দুই
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরির পর শিখর ধবন।
সকালে চেরিং ক্রস থেকে যাত্রী বোঝাই যে টিউব ওভাল অভিমুখী আসছিল, তাকে অনায়াসে আখ্যা দেওয়া যেত ‘ক্রিকেট এক্সপ্রেস’। মনে হচ্ছিল ওটা ওভাল নয়, ধর্মতলা স্টেশন যাচ্ছে। কারণ শ্বেতাঙ্গদের দেশে তাদেরই চিহ্নমাত্র নেই। কাতারে কাতারে ভারত সমর্থক আর তাদের হাতে নানান ধরনের বাদ্যযন্ত্র। কারও হাতে পতাকা। লর্ডসে এ সব ঢোকার অনুমতি দেয় না। কিন্তু ওভালে কোনও বাধা নেই। মাঠে আসার মেজাজটা শুধু আর পাঁচটা দিনের মতো নয়। আমাদের কামরায় ট্রেনটা ওভাল পৌঁছনোর আগে কেবলই এরা আলোচনা করছিল স্পট-ফিক্সিং আর গ্যাম্বলিং। তখন মনে হচ্ছিল ক্রিকেট কী শোচনীয় অবস্থায় তার ধাত্রীভূমিতেই এসে পৌঁছল যেখানে মাঠে পৌঁছবার সরল মাদকতার মধ্যেও লোকে সন্দেহের ভূত দেখছে।
খেলার শেষ দশ ওভার আগে থাকতেই যখন পরিষ্কার হয়ে গেল কারা জিতছে, গ্যালারি চার দিক থেকে ঢেউয়ের মতো আওয়াজ তুলছিল ধোনি। ধোনি। এক ধূসর স্যুট তখন ওভাল মাঠের ছাদে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বসিত ভাবে বললেন, “কী ব্যাটটাই না করছে শিখর ধবন! আমি আবার বলছি, সহবাগ-গম্ভীর-সচিন কাউকে আমার মনেই পড়ছে না। ওদের এতটুকু মিস করছি না।” বক্তার নাম কপিল দেব। তাঁর সঙ্গে একমত হওয়া ছাড়া মঙ্গলবারের ওভাল কোনও বিকল্প রাখেনি। টুর্নামেন্টে ওপেনিং উইকেটে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি পার্টনারশিপের পর রোহিত শর্মা যখন আউট হয়ে ফিরছেন। তাঁকে ওভাল-দর্শক যা সংবর্ধনা দিল সেটা সহবাগ-যুবরাজদের জন্য বরাদ্দ থাকে।
ধোনির অপেক্ষাকৃত তরুণ টিম অসমসাহসী মনোভাবে স্পট-ফিক্সিং আক্রান্ত ভারতীয় ক্রিকেট সমাজকে উন্নীত করল চমকপ্রদ ক্রিকেট-স্কিলের আলোয়। যে আলোয় সবচেয়ে বড় পাওয়ারের বাল্ব হল তাঁর মনোভাব!
শিখর-রোহিত এমন গরগরে ভঙ্গিতে শুরু করলেন যেন রানটা আগে তুলে দিতে পারার ওপর বিশেষ কোনও পুরস্কার রয়েছে। একটা করে বাউন্ডারি মারছেন তাঁরা, আর গ্যালারি গান চালিয়ে নাচছে জয় হো। কে বলবে এটা চার্চগেট নয়। চৌরঙ্গী নয়। চিন্নাস্বামী নয়! উচ্ছ্বাসের সেই ঝর্ণাধারায় কোথায় ভেসে গেলেন শ্রীনিবাসন। কোথায় তিহাড় থেকে বার হওয়া ক্লেদাক্ত শ্রীসন্ত। ক্রিকেটই ফোয়ারার মতন সেখান থেকে উঠে এল একমাত্র সত্য হিসেবে!
সকালে ম্যাচকেন্দ্রিক নিরাপত্তা যা দেখলাম, অভূতপূর্ব। প্রতিটি লোককে তার টিকিট-নির্দিষ্ট জায়গার বাইরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। ক্রমাগত নজর করে যাচ্ছে রক্ষীরা। এমন কখনও দেখিনি যে প্রেসবক্স থেকে টিভি বক্সে যাওয়ার ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞা। বক্সের বাইরে টিভি লাউঞ্জ। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নিজে অনুরোধ করেও তখন বৈধ ম্যাচ-কার্ড থাকা সাংবাদিককে সেখানে বসাতে পারছেন না। নিরাপত্তারক্ষীরা লর্ডসের সেই স্টুয়ার্ডদের মতো মোটেও বদমেজাজী নয়। তারা বরঞ্চ দুঃখপ্রকাশ করে বলছে, আইসিসি-র কড়া নির্দেশ। আমরা পালন করছি মাত্র।
রোহিত শর্মা আউট জানতেন ক্যারিবিয়ানরা। তাই তৃতীয়
আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের ফাঁকে রীতিমতো হাসি-ঠাট্টার মেজাজ।
ভাষ্যকারের বন্ধু-টন্ধুদের টিভি বক্সের কাছাকাছি যে অবারিত দ্বার থাকে, এ বার দেখা গেল সেটাও নিশ্চিহ্ন।
ওভাল উইকেটও তখন বিচিত্র আচরণ করছে। পুরো মেঘে ঢাকা আকাশ। শনশনে হাওয়া। অথচ ভুবনেশ্বর কুমারের বল সুইং করছে না। উমেশ যাদবের তো না-ই। ইংল্যান্ডের কপিবুক পরিবেশ অথচ বল সুইং-সিম করছে না। বরঞ্চ ঘুরছে এটা তখন এতই অস্বাভাবিক যে, মনে হচ্ছে কুচকুচে কালো চুলের সঙ্গে শ্বেতশুভ্র দাড়ির কম্বিনেশন দেখছি। ইংরেজ সাংবাদিক বলছেন, ধূসর স্যুটের থেকে মাইক্রোফোন ছিনিয়ে নিয়ে বলটা ধরিয়ে দিন। দেখবেন কতটা করে সুইং করছে। যাঁর কথা বললেন, তিনি অতি অবশ্যই কপিল দেব। কিন্তু কপিল ও সৌরভ ততক্ষণে ভারতীয় পেসারের ব্যর্থতা আর জাডেজার কৃতিত্বের ক্রিকেটীয় কারণ বিশ্লেষণ করে দিয়েছেন।
সৌরভ: আরে শুকনো উইকেট! দেখে বুঝছেন না! ইংল্যান্ড এটা অ্যাসেজের জন্য তৈরি করেছে। অস্ট্রেলিয়াকে এখানে ফেলে দু’দিক থেকে গ্রেম সোয়ান আর মন্টি পানেসরকে লেলিয়ে দেবে।
কপিল: মনে রাখবেন দমকা হাওয়া আর মেঘলা আকাশ মানেই সুইং নয়। বরঞ্চ বেশি হাওয়াতে সুইং করাতে অসুবিধে হয়। রিস্ট সোজা রেখে যে হাওয়ার মধ্যে স্ট্রেট পনেরো গজ ছোড়ার ক্ষমতা রাখে, সে সুইং পাবে। কিন্তু ওই জোর না হলে সুইং করবে না।
ধোনির স্যর জাডেজা ততক্ষণে অবশ্য চমৎকৃত করতে শুরু করেছেন। সৌরভ অবধি জাডেজার তারিফ করতে গিয়ে তাঁর প্রিয় শিষ্যকে আলোচনায় নিয়ে এলেন, “নাহ, এ জায়গাটা আরও ভাল রাখে। যুবরাজের চেয়েও বেটার। কিন্তু টেস্টে এই বোলিংয়ে চলবে না।” জাডেজা ততক্ষণে এ দেশে সমস্ত ভারতীয় বোলিং রেকর্ড চুরমার করে দিয়েছেন। একটা সময় যখন মনে হচ্ছে ১ উইকেটে ১০১ থেকে ক্যারিবিয়ানরা ভেঙে পড়ে নিজেদের হালফিলের টিপিক্যাল স্টাইলটাই আবার মেলে ধরল। খেলাটা গেল ঘুরে। ড্যারেন স্যামি অদ্ভুত একটা ইনিংস খেললেন যাকে ইংরেজি ক্রিকেট লেখক ব্যাখ্যা করবেন, কাউন্টার-পাঞ্চিং বলে!
স্যামি-কেমার রোচ দশম উইকেটে ৫১ রানের পার্টনারশিপ করলেন যাতে রোচের কোনও রানই নেই। অদ্ভুত পার্টনারশিপ যেখানে একজন ৫১। আর একজন ০। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান সমর্থক ওভাল মাঠে ততটাই সংখ্যালঘিষ্ঠ ছিল, নির্বাচনে জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়া প্রার্থী যতটা থাকে। কিন্তু এই পার্টনারশিপের পর তারাও অদ্ভুত টুপি ছুড়ে, শিঙা ফুঁকে জানিয়ে দিল আছে। তিরিশ বছর পর একটা বদলা চাখার জন্য প্রবল ভাবেই আছে।
তাঁদের একজন সম্ভাব্য সঙ্গী ম্যাঞ্চেস্টারে কাজ পড়ে যাওয়ায় এ দিন ওভালে আসতে পারলেন না। তিরিশ বছর আগে লর্ডসের খেলাটা যিনি বেশ কাছ থেকেই দেখেছিলেন। ক্লাইভ হিউবার্ট লয়েড এলে দেখতে পেতেন, অন্তত এ দেশে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বদলার জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।
তত দিন কপিলের দেশ এগিয়ে রইল ২-০। আজকের ৮ উইকেটে জয়টা বাদ দিন। এটা তো খুচরো।

ছিটকে গেল পাকিস্তান
পাকিস্তানের সেমিফাইনালে যাওয়ার ক্ষীণ আশাও শেষ। ভারত টানা দ্বিতীয় ম্যাচ জিতে ৪ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ ‘বি’-র শীর্ষে। পাকিস্তান দু’ম্যাচে হেরে গ্রুপে চতুর্থ। দুই ও তিনে দক্ষিণ আফ্রিকা আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পাকিস্তান শনিবার ভারতকে হারালে তাদের পয়েন্ট দাঁড়াবে দুই। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হবে না। শুক্রবার দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে যে টিম জিতবে তারা শেষ চারে চলে যাবে।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ
গেইল ক অশ্বিন বো ভুবনেশ্বর ২১
চার্লস এলবিডব্লিউ বো জাডেজা ৬০
ব্রাভো স্টাম্প ধোনি বো অশ্বিন ৩৫
স্যামুয়েলস এলবিডব্লিউ বো জাডেজা ১
সারওয়ান ক ধোনি বো জাডেজা ১
ব্রাভো ক জাডেজা বো উমেশ ২৫
পোলার্ড ক ভুবনেশ্বর বো ইশান্ত ২২
স্যামি ন.আ. ৫৬
নারিন ক কার্তিক বো জাডেজা ২
রামপল বো জাডেজা ২
রোচ ন.আ. ০
অতিরিক্ত
মোট (৫০ ওভারে) ২৩৩-৯।
পতন:২৫, ১০৩, ১০৫, ১০৯, ১৪০, ১৬৩, ১৭১, ১৭৯, ১৮২।
বোলিং: ভুবনেশ্বর ৮-০-৩২-১, উমেশ ৯-০-৫৪-১, ইশান্ত ১০-১-৪৩-১,
অশ্বিন ৯-২-৩৬-১, বিরাট ৪-০-২৬-০, জাডেজা ১০-২-৩৬-৫।

ভারত
রোহিত ক চার্লস বো নারিন ৫২
ধবন ন.আ. ১০২
বিরাট বো নারিন ২২
কার্তিক ন.আ. ৫১
অতিরিক্ত
মোট (৩৯.১ ওভারে)২৩৬-২।
পতন: ১০১, ১২৭।
বোলিং: রোচ ৬-০-৪৭-০, রামপল ৬-০-২৮-০, নারিন ১০-০-৪৯-২,
স্যামি ৪-০-২৩-০, ব্রাভো ৫-০-৩৬-০, স্যামুয়েলস ৪-০-১৭-০,
গেইল ১-০-১১-০, পোলার্ড ৩.১-০-২১-০।

ছবি: এএফপি





First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.