প্রবন্ধ ১...
অসাম্যের অঙ্ক নিয়ে বিভ্রান্তির অন্ত নেই
দারিদ্রের ধারণা এবং পরিমাপ নিয়ে নানা বিভ্রান্তির কথা বলেছি। অসাম্য নিয়ে বিভ্রান্তি আরও অনেক বেশি। কেন্দ্রীয় সরকারের দুই ভূতপূর্ব প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা শঙ্কর আচার্য ও রাকেশ মোহন ২০১০ সালে মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ার সম্মানে একটি প্রবন্ধ সঙ্কলন সম্পাদনা করেছিলেন। বইটিতে প্রয়াত অধ্যাপক সুরেশ তেন্ডুলকরের একটি লেখা ছিল। সেখানে একটা গল্প ছিল। অনেক বছর আগে ব্যাঙ্ককে একটি সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন মনমোহন সিংহ। তিনি তখন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। তেন্ডুলকর লিখেছেন, ‘বিভিন্ন প্রতিনিধি নিজের নিজের দেশের বাজার অর্থনীতির পরিচালনা সম্পর্কে বক্তব্য জানানোর পরে চিনের মন্ত্রী তাঁর দেশের সংস্কার কর্মসূচির একটি রূপরেখা পেশ করলেন।’ তাঁর বলা শেষ হলে মনমোহন সিংহ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ শান্ত কিন্তু দৃঢ় ভঙ্গিতে বললেন, ‘আপনারা যে নীতি অনুসরণের চেষ্টা করছেন তার ফলে কি দেশে অসাম্য বাড়বে না’? চিনের মন্ত্রী খুবই প্রত্যয়ের সঙ্গে জবাব দিলেন, ‘আমরা অবশ্যই তেমনটা আশা করছি’!
সম্পদ সৃষ্টির উল্টো পিঠে থাকে সম্পদ বণ্টনের প্রশ্ন। আজকাল ‘সর্বজনীন উন্নয়ন’ (ইনক্লুসিভ গ্রোথ) কথাটা খুব চলে। কথাটার নানা ব্যাখ্যা হতে পারে। এক অর্থে এর মানে হল, সমাজের প্রত্যেক মানুষ একটি ন্যূনতম জীবনধারণের মান অর্জন করবে, যেমন কেউ দারিদ্ররেখার নীচে থাকবে না, সেই রেখা যে ভাবেই নির্ধারিত হোক না কেন। এক বার দারিদ্ররেখা নির্ধারণ করা হয়ে গেলে দারিদ্র একটি অনাপেক্ষিক (অ্যাবসলিউট) ধারণা। অসাম্য কিন্তু চরিত্রে আপেক্ষিক (রিলেটিভ)। দু’ভাবে তার ব্যাখ্যা করা যায়, এবং এক একটি ব্যাখ্যা থেকে এক এক রকম নীতিতে পৌঁছতে পারি।
এক দিক থেকে অসাম্য দূর করার জন্য আমরা দাবি করতে পারি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিকাঠামো, আইনশৃঙ্খলা, আর্থিক সম্পদ, বিপণনের ব্যবস্থা, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় সকলের সমান ভাবে নাগালে থাকা দরকার। অন্য দিক থেকে বলা যায়, সাম্য মানে আয়ের সমতা সকলের আয় সমান হতে হবে। দুটি ধারণার পার্থক্য বোঝাতে লেখাপড়ার জগৎ থেকে একটা তুলনা দিতে পারি। প্রথম ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, প্রত্যেক ছাত্রের শিক্ষার সমান সুযোগ থাকা উচিত; দ্বিতীয় ক্ষেত্রে দাবি করা হচ্ছে, প্রত্যেক ছাত্র যেন সমান নম্বর পায়। নীতি নির্ধারণ সংক্রান্ত আলোচনায় এই পার্থক্যটা অনেক সময়েই যথাযথ ভাবে লক্ষ করা হয় না। ভারতে অসাম্য কমুক, এটা সকলেই চায়। কিন্তু দরকার সুযোগের সাম্য, আয়ের সাম্য নয়। আয় বা সম্পদ সমান করার দাবিটা এ দেশে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ার পুরনো মানসিকতার পরিণাম। সত্তরের দশকে সংবিধানের প্রস্তাবনায় সমাজতন্ত্রের অঙ্গীকার ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং পরে তা আর বাদ দেওয়া হয়নি।
১৯৮৯ সালে এই অনুসারে জনপ্রতিনিধি আইন সংশোধন করা হয়। তার ফলে এখন ভারতে সমাজতন্ত্রের আদর্শ স্বীকার না করলে কোনও দল স্বীকৃতি পায় না। সমাজতন্ত্র এক অদ্ভুত অস্বচ্ছ ধারণা। এর মানে ঠিক কী, তা কখনওই স্পষ্ট করা হয়নি। সংবিধানে এই ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার ফলে অনেক ক্ষতি হয়েছে। যেমন, সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতিমালার ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদটিকে আমরা একেবারে আক্ষরিক অর্থে ধরে নিতে শুরু করেছি। সেখানে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র বিশেষত আয়ের অসাম্য কমাতে চেষ্টা করবে, এবং কেবল বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে নয়, বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী বা বিভিন্ন বৃত্তিতে নিযুক্ত নানা গোষ্ঠীর মধ্যে অবস্থান ও সুযোগসুবিধার অসাম্য কমানোর জন্য সচেষ্ট হবে।’ দ্বিতীয় অংশটা নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু আয়ের অসাম্য কমানোর ফল সাংঘাতিক।
একটি উদ্ধৃতি শোনাই। কার উদ্ধৃতি, পরে বলছি। উদ্ধৃতিটি এই রকম: ‘এর পর আমরা যে ধারণাটি নিয়ে কথা বলব, তার নাম সাম্য।... এটাও এক ধরনের অবাস্তব ধারণা। পৃথিবীতে যথার্থ সাম্য কখনও হয়নি, হতে পারেও না। আমরা সবাই সমান হব কী করে? এই অসম্ভব রকমের সাম্য মানে আসলে মৃত্যু।... সম্পূর্ণ সাম্য মানে সমস্ত ক্ষেত্রে সমস্ত দ্বন্দ্ববিরোধের সম্পূর্ণ ভারসাম্য, সেটা কখনও সম্ভব নয়। এই রকম একটা অবস্থায় পৌঁছনোর আগে পৃথিবীটা যে কোনও ধরনের জীবনের পক্ষে অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে, কেউ সেখানে থাকবে না।... মানুষে মানুষে তফাত হয় কেন? পার্থক্যটা প্রধানত মস্তিষ্কের। আজকের দিনে উন্মাদ ছাড়া কেউ বলবে না যে, সবাই মস্তিষ্কের সমান শক্তি নিয়ে জন্মায়। আমরা অসম সামর্থ্য নিয়ে পৃথিবীতে আসি; আমরা কেউ বড় মাপের মানুষ, কেউ ছোট মাপের, এবং এই সত্যকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, এই প্রাকৃতিক অসাম্য আমাদের জন্মের আগেই নির্দিষ্ট হয়ে যায়।... অসাম্য যেমন সৃষ্টির জন্যই জরুরি, তাকে একটা সীমার মধ্যে রাখাও ঠিক তেমনই জরুরি।’ কথাগুলি বলেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
যখনই কোথাও আয়ের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে, তখনই প্রথমে আর্থিক অসাম্য বেড়ে যায়। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ সাইমন কুজ্নেট্স অনেক কাল আগে এটা দেখিয়েছেন। কেন এমন হয়, অর্থনীতিবিদরা তার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং পরিসংখ্যান দিয়ে সেটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই অসাম্যবৃদ্ধিকে জোর করে আটকানো ঠিক নয়, কেবল দেখতে হবে সবাই যেন সমান সুযোগ পায়।
অসাম্য মাপার নানা উপায় আছে। একটা হল জিনি কোএফিশিয়েন্ট। ১৯১২ সালে ইতালির সংখ্যাতত্ত্ববিদ কোরাদো জিনি একটি গবেষণাপত্রে এই পরিমাপটি প্রকাশ করেন। অসাম্যের সূচক হিসেবে আজও এটিই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়। এই সূচকের মান শূন্য থেকে এক পর্যন্ত হতে পারে। সকলের আয় (বা ব্যয়, বা যা-ই মাপা হোক) সমান হলে জিনি সূচক হবে ০ (চরম সাম্য), সব আয় এক জনের হাতে গেলে সূচকটি হবে ১ (চরম অসাম্য। এই দুই সীমার মধ্যে সূচক যত বাড়ে, অসাম্য তত বেশি। জাতীয় নমুনা সমীক্ষায় (এন এস এস) আয়ের হিসেব নেওয়া হয় না, নেওয়া হয় ভোগব্যয়ের হিসেব। এখন, মানুষের আয় যত বাড়ে, সাধারণত তার সঞ্চয়ের অনুপাত বাড়ে, মানে ব্যয়ের অনুপাত কমে। তাই ব্যয়ের অঙ্ক ব্যবহার করে জিনি সূচক কষলে তার মান যা হবে, আয়ের অঙ্কে সেটা আরও বেশি হওয়া স্বাভাবিক। অর্থাৎ, এন এস এস-এর পরিসংখ্যান থেকে জিনি সূচক বের করলে যে ফল পাওয়া যায়, আয়ের অসাম্য তার চেয়ে বেশি হওয়ার কথা।
সরকারি পরিসংখ্যান মানেই বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে হবে, এমন নয়। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক প্রতি বছর সাধারণ বাজেট পেশ করার ঠিক আগে চলতি বছরের অর্থনৈতিক সমীক্ষা প্রকাশ করে। ২০১২-১৩’র সমীক্ষার তেরো নম্বর অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ২০১০-১১ সালে ভারতে জিনি সূচক ছিল ০.৩৬৮। মজা হল, ২০১০-১১ সালে এন এস এস কোনও সমীক্ষা করেনি। তা হলে সরকার এই হিসেবটা পেল কোথা থেকে? আসলে রাষ্ট্রপুঞ্জের অন্তর্ভুক্ত ইউ এন ডি পি’র সে বারের হিউম্যান ডেভলপমেন্ট রিপোর্ট থেকে অঙ্কটা সমীক্ষায় তুলে নেওয়া হয়েছে। ইউ এন ডি পি কোন তথ্যের ভিত্তিতে অসাম্যের এই হিসেব কষেছেন, সেটা যাঁরা সমীক্ষা তৈরি করেছেন, তাঁরা খতিয়ে দেখেননি। দেখলে জানতে পারতেন, ওই হিসেবটা ২০১০-১১’র নয়, ওটা দশ বছরের (২০০১-১০) গড় হিসেবের ভিত্তিতে তৈরি। ইউ এন ডি পি এই হিসেব কোথা থেকে পেয়েছে? পেয়েছে সি আই এ’র পরিসংখ্যান থেকে। তার মানে সোজা কথায়, অর্থনৈতিক সমীক্ষার হিসেবটা খুবই বিভ্রান্তিকর।
তা হলে ভারতে অসাম্যের মাত্রা আসলে কেমন? বিভিন্ন রাজ্যই বা এ বিষয়ে কেমন করছে? পরের লেখায় আমরা সেই বিষয়েই আলোচনা করব।

দিল্লিতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতিবিদ


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.