পদত্যাগপত্র ধরাইয়া দিবার অস্ত্রটি রাজনীতিতে বহুল ব্যবহৃত। তবে কিনা, হুমকির ভিত্তিটি স্পষ্ট নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত না হইলে কিংবা মধ্যপথে নাটকীয় ভাবে প্রত্যাহৃত হইলে তাহা রাজনৈতিক আত্মহননের শামিল হইয়া উঠিতে পারে। অর্থাৎ, নীতিগত বিরোধ কেবল থাকিলেই চলে না, জন-প্রত্যক্ষেও তাহা বিশ্বাসযোগ্য হইতে হয়, তাহাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকিতে হয়। নতুবা সন্দেহ উঠে যে, পদত্যাগকারীর নিশ্চয়ই কোনও প্রচ্ছন্ন অভিপ্রায় ছিল, এবং সেই অভিপ্রায় নিশ্চয়ই ব্যক্তিগত স্বার্থ-জড়িত। লালকৃষ্ণ আডবাণীর ইস্তফা তাঁহার দল গ্রহণ না করিলেও তাঁহার ইস্তফাদানের ঘটনাটি ইতিহাসে লিখিত রহিল। প্রবল আবেগবশে দলের সমস্ত রকম পদ হইতে একসঙ্গে পদত্যাগের এই ঘোষণার ফল তাঁহার নিজের পক্ষে সুখকর হওয়া কঠিন। স্পষ্টতই তাঁহার এই চকিত সিদ্ধান্তটির পিছনে নীতিগত ভিত্তি ছিল অত্যন্ত দুর্বল। জনমানসে সেই নীতির যুক্তিটি এতটুকুও বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। অনুমান সহজ যে তাঁহার ব্যক্তি-স্বার্থ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষায় আঘাত লাগিয়াছিল বলিয়াই এত নীতি-বাচন।
দলের ‘আদর্শচ্যুতি’ ও ‘বিপথগামিতার’ যে অভিযোগ আডবাণী তাঁহার ইস্তফাপত্রে আনিয়াছিলেন, তাহা ঠিক কোন জায়গায়, এবং সেই জায়গায় আডবাণীর এত বড় আপত্তির কারণ কী, ইহাই ছিল প্রধান প্রশ্ন। যে ‘চ্যুতি’ কিংবা বিভ্রান্তির ইঙ্গিত তিনি করিতেছেন, আডবাণী নিজেই তো তাহাতে এ যাবৎ প্রভূত ইন্ধন জুগাইয়াছেন। যে ‘দেশ’-এর চিন্তা হইতে দল সরিয়া আসিতেছে বলিয়া তাঁহার ক্ষোভ, তিনি নিজেই তো মহাপরাক্রমে সেই সরিয়া আসিবার পথ প্রশস্ত করিয়াছিলেন। সে সব অনতি-অতীত কালের কথা যখন আডবাণী নিজে প্রখর হিন্দুত্ববাদের ধ্বজা তুলিয়া ধরেন, যে ধ্বজা আজ মোদীর নামে শোভিত। সেই ধ্বজাতলে ভারতীয় জনতা পার্টির উগ্রতর মুখটি নির্মাণের লক্ষ্যে আডবাণীই ঐতিহাসিক সব কার্যক্রম তৈরি করেন, যাহার কোনওটির নাম রথযাত্রা, কোনওটি অযোধ্যার ‘এক ধাক্কা অউর দো, বাবরি মসজিদ তোড় দো’। সে সব এই শতাব্দীরই কথা, যখন দাঙ্গাধ্বস্ত গুজরাত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বিজেপির প্রবাদপ্রতিম নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী ‘রাজধর্ম’ স্মরণ করাইয়া ভর্ৎসনা করিয়াছিলেন, কিন্তু দলের অন্যতম প্রধান নেতা হইয়াও লালকৃষ্ণ আডবাণী বাজপেয়ীর সপক্ষে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেন নাই! করেন নাই, কেননা তখন তাঁহার মনোমধ্যে আজিকার ‘নীতি’র অন্তর্দাহ জাগে নাই। ‘রাজধর্ম’ বা ‘দেশধর্ম’ কেন মোদী-পথে বিপন্ন হইতে পারে, সেই যুক্তি তাঁহার চিত্তে জ্বলন ধরায় নাই। বরং তিনি সোৎসাহে সেই পথপরিক্রমাতেই ব্যস্ত ছিলেন। ফলে আডবাণী যখন আজ বাজপেয়ীর আদর্শে স্থিত থাকিবার লক্ষ্যে ইস্তফার অস্ত্র হানেন, তাঁহার সেই বিক্ষোভে ‘মুখ’ অপেক্ষা ‘মুখোশ’টিই বড় হইয়া উঠে, নীতির প্রশ্ন ম্লান করিয়া তাঁহার নিজস্ব ক্ষুদ্র ব্যক্তি-স্বার্থ জ্বলজ্বল করিয়া উঠে।
স্বভাবতই নিজের ব্যক্তি-চরিতার্থ পূরণে বাধা আসিলে আডবাণীর মতো নেতারা দলীয় শৃঙ্খলার ধার ধারেন না, গণতান্ত্রিকতার তোয়াক্কা করেন না। বিজেপি-র ‘গোয়া ঘোষণা’য় কিংবা নাগপুরের সঙ্ঘ-মঞ্চে মোদীকে আগামী নির্বাচনে দলের প্রধান মুখ হিসাবে ঘোষণা দলীয় অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত, এবং দলীয় শৃঙ্খলার প্রতি আনুগত্য থাকিলে শত আপত্তি সত্ত্বেও সেই সিদ্ধান্ত ধার্য করাই ছিল সমস্ত দলকর্মীর রাজনৈতিক কর্তব্য। তাহা ছাড়া, নরেন্দ্র মোদীর এই নির্বাচন দলের উপরিতল হইতে অযৌক্তিক ভাবে চাপাইয়া দেওয়া, এমন অভিযোগ মোদী-বিরোধীরাও তুলিতেছেন না। দেশব্যাপী দলের সাধারণ সদস্যদের নিকট মোদীর নেতৃত্বই কাম্য। নীতীশ কুমারের বিহারও তাহা ইতিমধ্যে প্রমাণ করিয়া ছাড়িয়াছে। সুতরাং ভালমন্দ যাহাই হউক, এই মনোনয়ন গণতান্ত্রিক। দলের নিজস্ব নিয়মানুগ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যে সিদ্ধান্ত বলবৎ হইতেছে, আডবাণী তাহার বিরুদ্ধে এ হেন ছেলেমানুষি বিদ্রোহীপনা না দেখাইলেই পারিতেন। তাঁহার দল যে তাঁহার ইস্তফাপত্র গ্রহণ করিবে না, বরং কোনওমতে তাঁহাকে পার্শ্বচরিত্রের মতো জিয়াইয়া রাখিবে, তাহা প্রত্যাশিতই ছিল। রাজনৈতিক জীবনের শেষ পর্যায়ে এই অসঙ্গত অর্বাচীন আবেগপ্রবণতার পর্ব তাঁহার নেতৃনামটিকে কালিমালিপ্ত করিল। |