দুঁদে নেতা, বাঘা প্রশাসক, অঢেল অর্থ, অনেক শ্রমিক। সবই রয়েছে, তবু এ রাজ্যের কচিকাঁচাদের প্রথম পাঠ নিতে হচ্ছে রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। এ রাজ্যের বহু অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র চলে খোলা মাঠে, কিংবা এর-ওর বাড়ির দাওয়ায়, ক্লাবঘরে। কারণ, একাধিক প্রকল্পে বরাদ্দ টাকা একটি কাজে ব্যবহার করার (‘কনভারজেন্স’) উদ্যোগ বা দক্ষতা, কোনওটাই দেখা যাচ্ছে না জেলা প্রশাসনে।
ধরা যাক বীরভূম জেলার কথাই। সেখানে ৪৭৯৬ কেন্দ্রের মধ্যে ১১৭৬টিই চলে খোলা আকাশের নীচে। বাকিগুলির অধিকাংশেরই নিজস্ব বাড়ি নেই। দুবরাজপুর, নানুর, সাঁইথিয়া, এই ব্লকগুলিতে এই সমস্যা অত্যন্ত তীব্র। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, সহায়িকা, এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রশ্ন, যে কেন্দ্র থেকে মা ও শিশুর পুষ্টিকর খাবার বিতরণ, ও সেই সঙ্গে শিশুর মানসিক বিকাশের সূচনা হওয়ার কথা, তার এমন দশা হলে কাজ হবে কী করে?
অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের ঘর যাতে দ্রুত নির্মাণ করা যায়, তাই কেন্দ্রীয় সরকার নির্দেশ দিয়েছিল, ঘর নির্মাণের কাজে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের টাকা কাজে লাগানো যাবে। এই নির্দেশ এসেছে প্রায় তিন মাস আগে। বীরভূমেও সে নির্দেশ পৌঁছে গিয়েছে। ঠিক হয়েছে জেলার ১৬৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার প্রত্যেকটিতে এই অর্থ বর্ষেই দু’টি করে কেন্দ্র বানিয়ে দেওয়া হবে। কেন্দ্র প্রতি ৪.৫ লক্ষ টাকা খরচ হবে। অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পের জেলা নোডাল অফিসার বিশ্বজিৎ মোদক জানান, যে সব কেন্দ্রের ঘর নেই তার তালিকা ও প্রস্তাবিত জায়গার বিবরণ তৈরি করা হয়েছে। জেলার সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্প আধিকারিক হীরক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, অন্য জেলার মতো বীরভূমে জমি পাওয়ার সমস্যা নেই। তাই কেন্দ্র তৈরি করা কঠিন হবে না। প্রতিটি কেন্দ্রে থাকতে হবে একটি ঘর, রান্নাঘর এবং শৌচাগার।
কিন্তু কাজ শেষ হবে কবে? রাজ্যস্তরের চিত্রটি আশা জাগায় না। একশো দিনের কাজের প্রকল্পের একটি পয়সাও এখনও অবধি খরচ করা যায়নি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র তৈরিতে, স্বীকার করছে পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতর। রাজ্যের প্রতিটি জেলা প্রশাসনের কাছে কেন্দ্রীয় সরকারের সার্কুলারটি পৌঁছে দেওয়া সত্ত্বেও এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়নি জেলা প্রশাসনগুলি। একই আক্ষেপ সমাজকল্যাণ দফতরের কর্তাদেরও।
কেন এমন হচ্ছে? গলদ গোড়ায়। পরিকল্পনা তৈরিই হচ্ছে না। পুকুর কাটা বা রাস্তা তৈরির কাজের সঙ্গে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র তৈরির কাজের পার্থক্য রয়েছে। একশো দিনের প্রকল্পের অধীনে যে কোনও কাজে অদক্ষ শ্রমিকের মজুরির জন্য খরচ করতে হয় ৬০ শতাংশ টাকা, দক্ষ শ্রমিক ও নির্মাণদ্রব্যের জন্য ৪০ শতাংশ। কিন্তু অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র তৈরির কাজে অধিকাংশ খরচ হয় কাঁচামাল কিনতে। অদক্ষ শ্রমিকের মজুরি বাবদ লাগে সামান্য টাকা।
ফলে একশো দিনের প্রকল্প থেকে মজুরির টাকা মিললেও, কাঁচামালের টাকার জন্য ব্যবহার করতে হয় ত্রয়োদশ অর্থ কমিশন, বিআরজিএফ, পঞ্চায়েতের নিজস্ব তহবিল, এমন নানা বরাদ্দের টাকা। তবে কাজের বরাত দেওয়া যাবে না ঠিকাদারদের। একশো দিনের কাজের প্রকল্পের নিয়ম অনুসারে, পঞ্চায়েতকে নিজের উদ্যোগে কেন্দ্র নির্মাণ করাতে হবে। রাজমিস্ত্রি নিয়োগ করা যায় দক্ষ শ্রমিক হিসেবে।
কিন্তু একাধিক প্রকল্পের বরাদ্দকে কাজে লাগিয়ে পরিকল্পনা করে, ঠিকাদার বাদ দিয়ে উদ্যোগ এবং পরিশ্রম দরকার, তাতেই নারাজ পঞ্চায়েত ও জেলা প্রশাসন। “হিসাব জটিল হয়ে পড়বে বলে একশো দিনের কাজের প্রকল্পের টাকা ব্যবহার করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না জেলা প্রশাসনগুলি,” স্পষ্টই বললেন সমাজকল্যাণ দফতরের সচিব রোশনি সেন। একশো দিনের কাজের প্রকল্পের রাজ্য কমিশনার বলেন দিব্যেন্দু সরকার জানান, একশো দিনের কাজের নিয়ম অনুসারে প্রকল্প তৈরি করতে গেলে প্রতি কেন্দ্রের জন্য কমবেশি দেড় লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে ওই খাত থেকে। বাকি প্রায় তিন লক্ষ টাকা অন্যান্য প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে জোগাড় করতে হবে। “অনেক জেলার কর্তারা মনে করেছিলেন, কেবল একশো দিনের প্রকল্পের টাকা দিয়েই কেন্দ্র তৈরি করা যাবে। তা সম্ভব নয় দেখে তাঁরা উৎসাহ হারাচ্ছেন।”
নানা প্রকল্পের বরাদ্দ নিয়ে কেন্দ্র তৈরি কি খুব কঠিন কাজ? তা মানতে রাজি নন পঞ্চায়েত দফতরের এক প্রাক্তন শীর্ষ কর্তা। তিনি বলেন, “একশো দিনের কাজের পরিকল্পনাতেই দেখানো যায়, কোন প্রকল্প থেকে কত টাকা নেওয়া হবে। অতিরিক্ত প্রয়োজন হলে ‘সাপ্লিমেন্টারি বাজেট’ তৈরির ব্যবস্থাও রয়েছে। জটিলতা খুব বেশি কিছু নয়, অভাবটা সদিচ্ছার।”
অথচ একশো দিনের প্রকল্পের টাকা সদ্ব্যবহার করতে পারলে শিশুদের পুষ্টি আর শিক্ষার অধিকার সুরক্ষিত হত। আগামী তিন বছরে শৌচালয়-সহ মোট ৫০ হাজার অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র তৈরির লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে এ রাজ্যে। রোশনি সেন বলেন, “আমরা জেলা প্রশাসনগুলিকে বোঝাচ্ছি তারা যেন একশো দিনের প্রকল্পের টাকা অঙ্গনওয়াড়িকেন্দ্র তৈরির কাজে কী ভাবে লাগানো যায় তার উপায় বের করে। তা হলে এই প্রকল্প থেকে গড়ে পাঁচটি বাড়ির জন্য যে টাকা মিলবে তাতে অতিরিক্ত একটি বাড়ির টাকা বাঁচানো যাবে। উদ্বৃত্ত টাকায় আবার অতিরিক্ত বাড়িটি তৈরি হয়ে যাবে।” |