দাদা তৃণমূল বিধায়ক। বোন পঞ্চায়েত ভোটে সিপিএমের প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু শেষমেশ আর ভোটে লড়া হল না তাঁর। দাদার মদতে তৃণমূলের লোকজনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিলেন ওই মহিলা।
ঘটনা গোসাবার। স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক জয়ন্ত নস্কর। তাঁর বোন কঙ্কাবতী পাত্র পঞ্চায়েত সমিতির জন্য চুনাখালি পঞ্চায়েত আসনে সিপিএম প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন। সোমবার বাসন্তী ব্লক অফিসে গিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পরে তাঁর অভিযোগ, “দাদার মদতে তাঁর দলের লোকজন হুমকি দিচ্ছিল। শাসাচ্ছিল। ওদের দুষ্কৃতীরা মোটরবাইক নিয়ে বাড়ির চারিদিকে ঘোরাঘুরি করছিল। তাই মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিলাম।” মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহিলাদের পঞ্চায়েতের কাজে এগিয়ে আসার যে আবেদন জানিয়েছেন, সে কথা তুলে কঙ্কাবতীদেবীর আক্ষেপ, “মুখ্যমন্ত্রীর দলের লোকেরাই নির্বাচনে লড়তে বাধার সৃষ্টি করল।”
বোনের যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে জয়ন্তবাবু বলেন, “চুনাখালি এলাকায় কয়েকটি হাতেগোনা মোটরবাইক রয়েছে। মোটরবাইক বাহিনী দূরবিন দিয়েও চোখে পড়বে না। আমার এলাকায় কোনও সন্ত্রাসই নেই।” তাঁর দাবি, “বোন সিপিএম করে। সিপিএম যা শিখিয়ে দেয়, ও তাই বলে।” সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তী বলেন, “আমরা জেলার ত্রিস্তর পঞ্চায়েতেরই ৯৯ শতাংশ আসনে মনোনয়ন জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু তৃণমূলের সন্ত্রাসের জেরে সাত থেকে আট শতাংশ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছি।” প্রত্যাশিত ভাবেই তৃণমূল সন্ত্রাসের অভিযোগ মানেনি।
এ দিন মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন বাসন্তীর চরাবিদ্যা পঞ্চায়েতের আরএসপি প্রার্থী পঞ্চমী সর্দারও। আগেই ওই দলের ১৩ জন প্রার্থীই মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। সিপিএম প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ক্যানিং-২ পঞ্চায়েত সমিতির ১৭ নম্বর কালীকাতলা পঞায়েতের আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গিয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী সওকত মোল্লা। অন্য কেউ ওই আসনে কেউ প্রার্থী দেয়নি বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে।
মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন সোমবার হুগলির হরিপাল ব্লক অফিস চত্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জনা পঁচিশেক যুবক। এলাকায় যাঁদের পরিচিতি তৃণমূল সমর্থক হিসেবে। মাঝে মাঝেই বেজে উঠছে তাঁদের মোবাইল। তবে ব্লক অফিস চত্বরে এলাকার কোনও প্রথম সারির তৃণমূল নেতার দেখা পাওয়া যায়নি এদিন। সিপিএমের হুগলি জেলা সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরী বলেন, “সোমবার হুগলি জেলায় গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে ৮৫ জন, পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে ১৩ জন ও জেলা পরিষদ স্তরে ১ জন সিপিএম প্রার্থীকে জোর করে মনোনয়ন প্রত্যাহার করানো হয়েছে।”
সিপিএমের হরিপালের জোনাল সম্পাদক দুলাল ভৌমিকের অভিযোগ, “আমাদের প্রার্থী লক্ষ্মী রায়ের বাড়িতে ভোরবেলা তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা গিয়ে হামলা করে। আমরা পর্যবেক্ষক দীনেশ মণ্ডলকে অভিযোগ জানিয়েছি।” যদিও হরিপাল ব্লক তৃণমূল নেতা তুষার সিংহ রায় বলেন, “সিপিএম যা বলছে তা একেবারেই মনগড়া। জেজুঁরে সিপিএম টাকা দিয়ে একজনকে প্রার্থী করেছিল। জিততে পারবে না জেনে নিজেরাই মনোনয়ন তুলে নিয়েছে।”
এক সময়ের বাম-দুর্গ বর্ধমানে আবার স্রেফ ‘অনুরোধ’-এর জেরেই সোমবার একের পর এক মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন বিরোধীরা।
এ দিন কেতুগ্রাম ১ ব্লক অফিসে গিয়ে দেখা যায়, একে একে বিরোধী প্রার্থী আসছেন। বিডিও-র ঘরে গিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে ফিরে যাচ্ছেন। প্রত্যাহার করছেন কেন? বেশির ভাগেরই মুখে কুলুপ। ইতিউতি তাকিয়ে কয়েকজন বললেন, “চারিদিক থেকে নাম প্রত্যাহার করার জন্য অনুরোধ এসেছিল। গতকাল তৃণমূলের কয়েক জন বাড়ি গিয়েছিল। বাড়ির মহিলাদের নাম প্রত্যাহার করার জন্য বলে এসেছে। সেই অনুরোধ ফেলি কী করে? পরিস্থিতি বুঝতেই তো পারছেন।” আপনাদের নাম? “দয়া করে নাম জানতে চাইবেন না। বউ-বাচ্চা নিয়ে বাড়িতে তো থাকতে হবে!’’
কালনা ১ ব্লকে যাঁরা এ দিন মনোনয়ন প্রত্যাহার করলেন, তাঁদের বেশির ভাগই সাংবাদিকদের এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। বেগপুর পঞ্চায়েতের এক যুবক বললেন, “আমাদের বন্ধু-বান্ধব সবাই তৃণমূলে রয়েছে। আমিও মনে প্রাণে তৃণমূলী। ভুল করে কংগ্রেসের হয়ে মনোনয়ন তুলেছিলাম। আজ প্রত্যাহার করলাম।” তৃণমূলের এক নেতা পাশ থেকে বললেন, “কাউকে মনোনয়ন প্রত্যাহারের ব্যাপারে জোর করা হয়নি। প্রমাণ হল তো!”
বাঁকুড়ার ইন্দাস ব্লকে তৃণমূলের হুমকিতে তাঁদের ১২ জন গ্রাম পঞ্চায়েত প্রার্থী ও ৩ জন পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছেন বলে অভিযোগ তুলেছে সিপিএম। দলের ইন্দাস জোনাল সম্পাদক অসীম দাসের অভিযোগ, “করিশুণ্ডা পঞ্চায়েতের পাহাড়পুর বুথের প্রার্থী শেখ সেলিমকে সাদা কাগজে সই করিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহারের চেষ্টা করে তৃণমূলের লোকেরা।” দলের জেলা নেতৃত্ব এ ব্যাপারে বিডিও, নির্বাচনী পর্যবেক্ষক ও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। ইন্দাসের বিডিও পুষ্পেন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “অভিযোগ পেয়ে তদন্ত করে প্রার্থীদের সশরীরে এসে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্য বলা হয়। যাঁরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন, তাঁদের বক্তব্য ভিডিও-রেকর্ড করা হয়েছে।”
ইন্দাস লাগোয়া পাত্রসায়রেও শাসকদলের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন বামেরা। এ দিন পাত্রসায়র দক্ষিণের সিপিএম প্রার্থী মীরারানি দে-কে তৃণমূলের লোকেরা গাড়িতে বিষ্ণুপুর মহকুমাশাসকের অফিসে তুলে নিয়ে গিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করায় বলে অভিযোগ সিপিএমের পাত্রসায়র জোনাল সম্পাদক লালমোহন গোস্বামীর। তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্ব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন।
রাজ্যে শাসকদলের চোখ রাঙানিতেই এ দিন পূর্ব মেদিনীপুরের বিভিন্ন জায়গাতেও তাঁদের প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন বলে অভিযোগ বামেদের। পটাশপুর ২ ব্লকের সাউৎখণ্ড গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৮টি আসনের মধ্যে ১৬টি ও আড়গোয়ালে ১৯টির মধ্যে ১৭টিতে তাদের দলীয় প্রার্থীরা মনোনয়ন তুলে নিতে বাধ্য হয়েছেন বলে দাবি সিপিএমের। দলের প্রতাপদিঘি জোনাল কমিটির সম্পাদক কালীপদ দাস মহাপাত্র বলেন, “রবিবার রাতভর ওই দুই এলাকায় বাম প্রার্থী ও নেতাদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে তৃণমূলের লোকেরা ভয় দেখিয়েছে। কোথাও ভাঙচুর করেছে। কোথাও মারধর। ভয়ে প্রার্থীরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।”
মনোনয়ন দখিলের পরে প্রার্থীদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে দিয়েছিলেন পটাশপুর ১ ব্লকের চিস্তিপুর গ্রামের বাসিন্দা তথা সিপিএমের মংলামাড়ো লোকাল কমিটির সম্পাদক চিন্তামণি মাইতি। অভিযোগ, ‘সেই আক্রোশে’ রবিবার রাতে তাঁর বাড়িতে হামলা চালায় তৃণমূলের মোটরবাইক বাহিনী। তৃণমূল অবশ্য অভিযোগ মানেনি।
অসন্তোষ এবং ক্ষোভের ছবি অবশ্য শুধু বাম-শিবিরেরই সীমাবদ্ধ নয়। সোমবার, মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিনে শাসকদলের অনেকেরই মন খারাপ, ক্ষোভ, বা দেখে নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়ার টুকরো দৃশ্য দেখা গেল পশ্চিম মেদিনীপুরের বিভিন্ন ব্লক অফিস ও মহকুমাশাসকের দফতরে। এ দিন যাঁরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করলেন, তাঁদের একটা বড় অংশ তৃণমূলের হয়ে ভোটে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। এক জনকে দল প্রতীক দিয়েছে। বাকিদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যাঁরা নির্দেশ মেনেছেন, তাঁদের অনেকেই হতাশ। যেমন, কেশপুর থেকে জেলা পরিষদ আসনে মনোনয়ন দেওয়া তৃণমূলের প্রাক্তন ব্লক সভাপতি চিত্ত গরাই, জেলা নেতা শেখ ইমদাদুল ইসলাম ও মীর আরশেদ আলি এ দিন মহকুমাশাসকের অফিসে মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন। হতাশ গলায় ইমদাদুল বললেন, “কী আর করব। দলের সিদ্ধান্ত তো মানতেই হবে।”
দলীয় নির্দেশ মেনে মনোনয়ন তুললেন না, তৃণমূলের এমন প্রার্থীরও দেখা মিলল। বেলপাহাড়ি ব্লকের ৬৪ নম্বর জেলা পরিষদ আসনে অমৃত সরেন যেমন। |