বারাসতের বাসিন্দা আপনারা যাঁরা কামদুনি-বিডিও অফিস-মধ্যমগ্রাম নরকযাত্রা সড়ক দিয়ে কখনও গেছেন, আর কোনও দিন যাবেন না অথবা কখনও যাননি, তাদের বলি ওই পথে নির্ভয়ে হাঁটা আপনাদের জন্মগত অধিকার। এত সহজ একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে ন্যাকড়ার পুতুলের মতো কেটে ফেলে দেওয়া? এত সহজ রাস্তার পাশে বেআইনি মদের ঠেক দিনের পর দিন বসিয়ে রাখাচোলাইওয়ালাদের গায়ে আঁচড়টি লাগতে না দিয়ে? এত সহজ আবগারি-পুলিশ সকলের চোখ ফিরিয়ে বসে থাকাপুলিশের এফআইআর নিতে অস্বীকার করাকার এলাকা না জানার দোহাই দিয়ে? এত সহজে রাজনৈতিক আশ্রয়ে বহাল তবিয়তে থাকবে সমাজবিরোধীরাযাতে ধর্ষণের পর খুন করবে, না জ্যান্ত রাখবে ভাবতে তাদের বিন্দুমাত্র সময় না লাগে? এর কোনওটাই সহজ নয়। ছিল না। এতগুলি বেআইনি কাজ ও সরকারি ঔদাসীন্যের সমাপতনও কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়। সেই জন্য যখন ইন্টারনেটে আজকের প্রথম পাতা পড়তে পড়তে স্ক্রিন থেকে আমার চোখে-মুখে ওই আক্রান্ত-নিহত মেয়েটির রক্ত ছিটে এসে লাগে, আমি বুঝি এই ঘটনাটি দিল্লির গত ডিসেম্বরের গণধর্ষণের ঘটনার চেয়েও অনেক বেশি ভয়াবহ ও যড়যন্ত্রমূলক। দিল্লির ঘটনায় সারা দেশ নড়ে উঠেছিল, বর্মা কমিশন বিশদ রিপোর্ট দিয়েছিল, বিচার পর্ব প্রায় শেষের মুখে কিন্তু বারাসত যেহেতু দিল্লি নয়, এমনকী কলকাতাও নয়, তাই রাজনৈতিক-প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়ায় সচেতনতার ছিটেফোঁটাও নেই। দিল্লির ঘটনাটি ঘটেছিল চলন্ত বন্ধ বাসে এবং সেখানে পূর্বপরিকল্পনার জন্য সময় ছিল অল্প। বারাসতে দিনের পর দিন সুপরিকল্পিত ভাবে বেআইনি মদভাটিগুলিকে বসিয়ে বাড়তে দেওয়া হয়েছে, রাস্তা রাখা হয়েছে অন্ধকার, মেয়েদের উপর হামলার ঘটনার কোনও তদন্ত হয়নিসমাজবিরোধীরা রাজনৈতিক স্নেহছায়া এমন মাত্রায় পেয়েছে যে, তারা জানে যে-কোনও মেয়েকেই তুলে নেওয়া যায় যেহেতু তাদেরই সুবিধার দিকে চোখ রেখে পুলিশ এফআইআর নেবে না এবং যথাসময়ে ঘটনাস্থলে এসে বলবেএ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনও অভিযোগ নেই। |
এই যে এলাকার মানুষের, বিশেষ করে মায়েদের ক্ষোভ ফেটে পড়েছে ঘটনাটি ঘিরে, আশা করি মদভাটি ভেঙে দেওয়ার পর তা নিভে যাবে না। হিংসামুক্ত পরিবেশ একটি মেয়ের জন্মগত অধিকার। এই লড়াইকে যে একা জীবন দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছে তার প্রতি সম্মানে আসুন আমরা সকলে মিলে ওই পথ হাঁটি, জনাকীর্ণ, কোলাহলপূর্ণ, সমাজবিরোধী-মুক্ত করে দিই। সংখ্যায় আমরাই সমধিক, রাজনীতিক-প্রশাসন-সমাজবিরোধীরা নয়। মনে রাখবেন, বারাসতে যা ঘটেছে তা কোনও একক আকস্মিক আক্রমণ নয়। যে মেয়েরা পড়াশোনা করে, বাইরে বেরিয়ে, স্বাধীন ভাবে বাঁচতে চায় তাদের প্রতি গভীর ষড়যন্ত্রে তৈরি এক সুপরিকল্পিত ঘৃণার আক্রমণএর পর কোনও মেয়ে যেন একা পথে না বেরোয়! তাদের দাদারা, বাবারা, কাকারা যেন প্রাণ হাতে করে জলে-ঝড়ে বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে আনার জন্য আজীবন তৈরি থাকেনদরকারে রাজীব দাসের মতো নিজের প্রাণ দিয়েও!
এ আঘাত সবচেয়ে বেশি আসবে প্রথম প্রজন্মের শিক্ষিত মেয়েদের উপরযাতে তারা সাহস করে ক্ষমতার বৈষম্যের বেড়াটি না ডিঙোয়, বরং নাবালিকা অবস্থায় বিক্রি হয়ে, পাচার হয়ে, অপহৃতা হয়ে, নামমাত্র বিয়েতে বিকিয়ে, অপুষ্ট সন্তানের জন্ম দিয়ে বৈষম্যের পাহাড়টিকে আরও মজবুত করে।
মনে রাখবেন, যে রাজনৈতিক নেতা বা দল সমাজবিরোধীদের প্রশ্রয় দেয়, তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর গ্রহণযোগ্য। কারণ তারা অপরাধের মদতদাতা। তাদের সামাজিক বয়কট করুন এবং ভোটে প্রার্থী হলে তাদের পরাজিত করুন। মনে রাখবেন প্রশাসনের আধিকারিক, আবগারি, পুলিশ সকলেই করদাতাদের টাকায় মাইনে পান। তাদের কাছ থেকে যদি পরিষেবা না পান এবং তা যদি পরোক্ষ ভাবেও সমাজবিরোধী দুষ্কৃতীদের প্রশ্রয় দেয়, তবে প্রশাসনের উচ্চতর স্তরে এবং কোর্টেও নালিশ জানানো প্রয়োজন। ধর্ষক ও হত্যাকারীদের সর্বাধিক শাস্তি হওয়া দরকারকিন্তু সবচেয়ে আগে দরকার, সময়মতো এফআইআর। কিন্তু পুলিশ এ ক্ষেত্রেও অভিযোগ নিতে অস্বীকার করেছেদিল্লির ঘটনা, পশ্চিমবঙ্গের নানা ঘটনা ও বর্মা কমিশনের নানা সুপারিশের পরেও।
এ বার আপনারা, নারী ও পুরুষ, সমবেত ভাবে নারীর প্রতি হিংসার বিরুদ্ধে একজোট হন একে আর মেয়েদের সমস্যা বলে চিহ্নিত করে রাখবেন না। পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ভোটে, খেতের কাজে, স্বয়ংসহায়ক দলে, স্কুল-কলেজে মেয়েদের দৃশ্যমানতা স্পষ্টতই অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাদের কাছে, যারা ক্ষমতার সমবণ্টনে বিশ্বাস করে না। অপরাধী-সমাজবিরোধী আজ পথ থেকে একটি বা একাধিক মেয়েকে টেনে নিয়ে গেছে, রাজনৈতিক পিঠ চাপড়ানি আর প্রশাসনিক প্রশ্রয় পেলে কাল সে আপনার ঘরেই ঢুকে আসবে আর পুরুষ বলে আপনাকে রেয়াত করবে না।
আসুন আমরা একত্রে নরকযাত্রার পথগুলিকে জনসমুদ্রে পরিণত করি। |