কারখানার পাঁচিলের উপরে আছড়ে পড়ছে রোষ। তার ধাক্কায় ভেঙে পড়ছে দশ ফুট উঁচু পাঁচিলের একাংশ। রাস্তায় নেমে এসেছেন শ’য়ে শ’য়ে মহিলা।
ক্ষিপ্ত নারী-পুরুষের দাবি, যে পাঁচিলের আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক নৃশংসতায় ধর্ষণ করে মারা হয়েছে ছাত্রীটিকে, সেই জমিতেই তৈরি করতে হবে একটি কলেজ। যার নাম হবে ওই ছাত্রীর নামে। ওই জমিতেই তৈরি করতে হবে একটি নতুন থানাও।
ঘটনার পর কেটে গিয়েছে ৭২ ঘণ্টা। সোমবার সকাল থেকে নামা বৃষ্টিও কামদুনি ও তার আশপাশের এলাকার মানুষের ক্ষোভের আগুন নেভাতে পারেনি। বরং এ দিন এলাকার বাইরে থেকেও কিছু মানুষ এসে শরিক হয়েছেন প্রতিবাদের। তাঁদের কোনও রাজনৈতিক রং নেই। ঠিক যেমনটি হয়েছিল দিল্লির ঘটনার পরে। |
এ দিন ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেই কামদুনি বাসস্ট্যান্ডে জড়ো হতে থাকেন মানুষজন। জমায়েতে একটি বড় অংশ জুড়ে ছিলেন এলাকার স্কুল-কলেজের পড়ুয়ারা। শুধু এলাকার মানুষ নন, ছিলেন তাপসী চট্টোপাধ্যায়ের মতো ‘বাইরের’ মানুষও। যিনি কামদুনির ঘটনা শুনে এ দিন ছুটে এসেছেন সুদূর দিল্লির গ্রেটার অশোকা থেকে। রবিবার বিকেলে তিনি দিল্লি থেকে এই রাজ্যে পৌঁছন। তার পর সকালে সোজা কামদুনি।
বাসস্ট্যান্ডে প্রতিবাদের পোস্টার-প্ল্যাকার্ড ঠিক করছিলেন চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই তাপসী দেবী। এত দূর থেকে এলেন কেন? আসলে নিজের এক ব্যক্তিগত জ্বালার সঙ্গে কামদুনির বেদনা একাকার হয়ে গিয়েছে ওই মহিলার কাছে। তাপসীদেবীর কথায়, “২০০১ সালে দুর্গাপুরে আমার দিদির ১০ বছরের মেয়েকে এ ভাবেই মেরে ফেলেছিল দুষ্কৃতীরা। কেউ ধরা পড়েনি। সেই জন্যই আমি গ্রামবাসীদের পাশে দাঁড়াতে এসেছি।” |
বাসস্ট্যান্ডে জমায়েত হওয়ার পর মিছিল করে যেতে যেতে প্রথমেই জনতার ক্ষোভ গিয়ে পড়ে বিশাল প্রাচীর ঘেরা ওই আট বিঘে জমির উপর। পাঁচিলের একাংশ গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর খড়িবাড়ি-বারাসত রোড ধরে মিছিল রওনা হয় বারাসত-২ নম্বর বিডিও অফিসের উদ্দেশে।
সোমবার পঞ্চায়েত ভোটের নাম প্রত্যাহারের শেষ দিনে ব্লক অফিসে ছিল ব্যস্ততা। এই পরিস্থিতিতে মিছিল আসছে জানতে পেরে প্রমাদ গোনে পুলিশ-প্রশাসন। গোটা বিডিও অফিস কার্যত মুড়ে ফেলা হয় পুলিশ আর র্যাফ দিয়ে। পুলিশকর্মীরা আন্দোলনকারীদের কাছে আবেদন করেন, ১৪৪ ধারা চলছে। এই অবস্থায় তাঁরা যেন বিডিও অফিসের সামনে না-যান।
আবেদন মেনে বিডিও অফিস থেকে ২০০ মিটার আগে থেমে যায় মিছিল। কিন্তু মিছিল থেকে পাল্টা দাবি ওঠে, “বিডিও-কে তা হলে বেরিয়ে আমাদের কাছে আসতে বলুন।” অগত্যা রাস্তায় আসেন বিডিও দেবদুলাল পাত্র। জনতার কাছে এসে হাত জোড় করে তিনি বলেন, “এই ঘটনায় প্রশাসনের পক্ষে আমরাও মর্মাহত। দোষীদের চরম শাস্তি হবেই।” জনতা চিৎকার করে জানায়, “আমরা ক্ষতিপূরণ চাই না। যে আট বিঘা জমির মধ্যে আমাদের মেয়েকে গণধর্ষণের পর করা খুন হয়েছে, ঠিক সেই জায়গায় তার নামে একটি কলেজ ও থানা চাই।”
ক্ষোভে ফুঁসছে রাজারহাটের ডিরোজিও কলেজও। যেখানে দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন ওই ছাত্রী। কলেজে ঢুকতেই দেখা গেল, ওই ছাত্রীর ছবিতে মালা পরানো, পাশে দোষীদের চরম শাস্তির দাবিতে লেখা বিভিন্ন পোস্টার। কলেজ অধ্যক্ষ থেকে শিক্ষক, তৃণমূল ছাত্র পরিষদ থেকে এসএফআই, সকলেই পুলিশি গাফিলতির অভিযোগ তুলে সরব। শনিবারই ওই ছাত্রীর বাড়িতে গিয়েছিলেন কলেজের অধ্যক্ষ দিব্যেন্দু তলাপাত্র। তাঁর কথায়, “ওই এলাকা থেকে প্রচুর ছাত্রছাত্রী আমাদের কলেজে আসে। ছাত্রছাত্রীদের নিরাপদে বাড়ি ফেরা নিয়ে আমরাও আতঙ্কিত। পুলিশ যদি এটুকু নিরাপত্তা না-দেয়, তা হলে কী করে হবে?” ওই ছাত্রীর স্মরণে মঙ্গলবার একটি সভার আয়োজন করেছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। কলেজের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রীতম ধর বলেন, “ঘটনার পর থেকে আমরা পরিবারের সঙ্গে রয়েছি। এখানে রাজনীতির কোনও ব্যাপার নেই। আমরা শুধু চাই, দোষীদের কঠোর শাস্তি হোক। খড়িবাড়ি-কামদুনি এলাকা দিয়ে যাতায়াত করতে আমাদের কলেজের ছেলেমেয়েরা সত্যিই ভয় পায়।”
সোমবার ওই ছাত্রীর বাড়িতে যান কংগ্রেস নেতৃত্ব। প্রতিশ্রুতি মতো অবশ্য সোমবারও পুলিশ ক্যাম্প বসেনি ওই এলাকায়। এই নিয়ে সরব হন এলাকার বহু মানুষ। তবে এলাকায় পুলিশ ও র্যাফের পিকেট রয়েছে। এর মধ্যেই এক মহিলাকে নিগ্রহের অভিযোগে বারাসত রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মী নব্যেন্দু ভট্টাচার্যকে সোমবার পুলিশ গ্রেফতার করেছে। কামদুনির ঘটনাতেও এ দিন আরও দু’জন গ্রেফতার হয়েছে। তাদের নাম ইমানুল মোল্লা ও আমিনুল ইসলাম। স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, রাজনৈতিক পালাবদলের পর অভিযুক্তেরা তৃণমূলের দিকে ঝুঁকেছে, আগে তারা ছিল সিপিএম-আশ্রিত।
এ দিন উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পুলিশ তদন্তের সমস্ত নথিপত্র সিআইডি-র কাছে তুলে দেয়। এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) বাণীব্রত বসু বলেন, “অভিযুক্তেরা হেফাজতে থাকাকালীনই যাতে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়, আমরা সেটাই নিশ্চিত করতে চাইছি।”
|