রাফায়েল নাদালের মহাকীর্তির পরের দিন প্রথমেই আমার মনে পড়ছে, এক বছর আগের এ রকম জুন মাসেরই একটা দিনের কথা।
দু’হাজার বারো উইম্বলডনের চতুর্থ দিন। গোটা টেনিস বিশ্বকে হতভম্ব করে দিয়ে নাদাল র্যাঙ্কিংয়ে একশোরও ওপরে থাকা প্লেয়ার লুকাস রোসলের কাছে দ্বিতীয় রাউন্ডে হেরে গিয়েছে! অল ইংল্যান্ড টেনিস ক্লাব থেকে বেরোচ্ছি, আমাদের আমলের স্প্যানিশ কিংবদন্তি ম্যানুয়েল সান্তানার সঙ্গে দেখা। “জয়, রাফায়েলের হারের চেয়েও আমাকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে ওর আজকের চোটটা। হাঁটু ধরে যে ভাবে লকাররুমে ওকে যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখে এলাম একটু আগে, মনে হচ্ছে আর সার্কিটে পুরোদমে ফেরা মুশকিল ওর!” নিজের দেশের সর্বকালের সেরা টেনিস প্লেয়ারকে নিয়ে সত্তরোর্ধ্ব সান্তানার গলায় উৎকণ্ঠা, আবেগ মিলেমিশে একাকার। সান্তানাকে সে দিন যেটা বলেছিলাম, এই লেখাতেও হুবহু সেটাই বলছি। আমাদের সময় এ রকম চোট থেকে সেরে উঠে আবার সেরা ফর্মে খেলাটা হয়তো সত্যিই অসম্ভব ছিল। কিন্তু বর্তমানে অত্যাধুনিক স্পোর্টস মেডিসিন, রিহ্যাব, ফিজিওথেরাপি, একঝাঁক সাপোর্ট স্টাফের কল্যাণে বড় চোট থেকে সম্পূর্ণ সেরে উঠে আবার পুরোদমে খেলা সম্ভব। তবে তার জন্য সবার আগে সেই প্লেয়ারকে নিজেকেও প্রচণ্ড ফিট, শক্তিশালী, মানসিক ভাবে ভীষণ পজিটিভ হতে হবে। নাদালের মধ্যে প্রতিটা গুণই একটু বেশিই পরিমাণে আছে।
রাফায়েল নাদাল সর্বকালের সেরা ক্লে কোর্ট প্লেয়ার, এটা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। ছ’বারের ফরাসি ওপেন চ্যাম্পিয়ন এবং তিন বার একই বছরে (তিন সপ্তাহের পিঠোপিঠি) রোলাঁ গারোর ক্লে আর উইম্বলডনের ঘাসের কোর্টে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতা বিয়র্ন বর্গকে মাথায় রেখেও নাদালকেই সর্বকালের সেরা বলা যায়। নাদালের মতো সর্বোচ্চ মানের অ্যাথলিট ছিল না বর্গ। কোর্টে নাদালের ওই অবিশ্বাস্য রকমের গতিও ছিল না বর্গের। ফিটনেসও নয়। সব সারফেস মিলিয়ে সর্বকালের সেরা টেনিস প্লেয়ার আমাকে বাছতে দিলে এই মুহূর্তে আমার র্যাঙ্কিং এ রকম:
১) রড লেভার
২) ডোনাল্ড বাজ,
৩) রজার ফেডেরার। |
তবে হাঁটুর মারাত্মক চোট সারিয়ে সাত মাস পর কোর্টে ফিরে ফরাসি ওপেন-সহ ন’টা টুর্নামেন্টের সাতটায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর নাদাল যদি পরের মাসে উইম্বলডনও জেতে, তা হলে আমার মতে ও-ই টেনিসে সর্বকালের সেরা। আর সেই সম্ভাবনাও এ বার আছে। ফেডেরারের দিন শেষ বলেই আমার ধারণা। জকোভিচ কোনও দিন উইম্বলডন জেতেনি। ব্রিটিশ অ্যান্ডি মারের উইম্বলডনে নামা মানেই প্রাণান্তকর টেনশন। সেখানে নাদাল দু’বার উইম্বলডন জিতেছে। খুব ভাল করে জানে পৃথিবীর সবচেয়ে ঐতিহ্যশালী গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিততে কী-কী করতে হয়।
ক্লে কোর্টে নাদালকে আক্ষরিক অর্থেই অপরাজেয় দেখানোর কারণ, ওর খেলাটাই চটচটে, স্লো কোর্টের উপযোগী। বেশি বাউন্সের কোর্টে ওর টপস্পিনগুলোয় অবিশ্বাস্য রকম স্পিন থাকে। বাঁ-হাতি বলে আরও বেশি সুবিধে পায়। যেহেতু নাদালের ফোরহ্যান্ড শট স্বাভাবিক সুইংয়ে সর্বদা ডানহাতি প্রতিদ্বন্দ্বীর ব্যাকহ্যান্ডে যায়, রিটার্ন করা আরও কঠিন হয়। হার্ডকোর্ট বা গ্রাসকোর্টে নাদালের শটে অতটা বেশি স্পিন না থাকলেও ওর পাসিং শটে এত বেশি পাওয়ার, কোর্ট কভারিং এতটাই দুর্ধর্ষ যে বিপক্ষের ‘উইনার’ শট নেওয়া প্রায় অসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।
অথচ নাদালের কেরিয়ারে বড় বড় চোটের কথা ভাবলে ওর আটটা ফরাসি ওপেন-সহ এক ডজন গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয় সত্যি ঘটেছে বলে যেন বিশ্বাসই হয় না! ২০০৫-এ, যে বছর থেকে ফরাসি ওপেনে নাদাল-যুগ শুরু, সে বারই ওর বাবা আবিষ্কার করেন, ছেলের বাঁ পায়ের একটা হাড়ের গঠনেই সমস্যা আছে। এমনকী সেবাস্তিয়ান নাদাল পরামর্শ দেন রাফায়েলকে, টেনিস ছেড়ে গল্ফে যাও। নাদাল তখন উনিশের টিনএজার। যে বয়সে শরীর হাজার সমস্যাতেও রবার বলের মতো লাফিয়ে ওঠে। কিন্তু ২০১৩-য় নাদালের বয়স সাতাশ। টেনিসের পক্ষে মধ্যবয়স। নাদাল সম্পর্কে ওর ঘনিষ্ঠ স্প্যানিশ টেনিসমহল থেকে যতটুকু জানিটানি, কোর্টের বাইরে ওকে বলা যায় বেশ ভিতু স্বভাবের। আকাশে বিদ্যুৎ ঝলকে বাজ পড়লে ভয় পায়! সমুদ্রে নামতে ভয় পায়, সেটার তলদেশ দেখা যায় না বলে! জেট বিমানে জার্নিতেও ওর ভয়! |
আমার অবশ্য নাদাল নিয়ে অন্য ভয় ছিল। নাদালের দুই খেলা-পাগল কাকা ওকে শিশু বয়স থেকে সর্বোচ্চ মানের অ্যাথলিট বানাতে মরণপণ করেছিলেন। সেই ছেলে হাঁটুর চোটে মাত্র সাতাশে খেলা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলে বাকি বিরাট জীবনটা কী ভাবে কাটাবে? কতটা বেশি অবসাদে ভুগবে? নাদালের কাকা-কাম-বরাবরের কোচ টনি নাদালের আমেরিকার নামী কাগজে দেওয়া একটা ইন্টারভিউ দিন কয়েক আগে পড়ছিলাম। টনি ফাঁস করেছেন, “চার মাস আগে চিলির ভিনা দেল মার-এ রাফায়েলের প্রত্যাবর্তন টুর্নামেন্টে ওর খেলা ছন্নছাড়া ছিল। পরের ট্যুরে সাও পাওলোয় প্রথম রাউন্ডের রাতে বেচারা কান্নায় একদম ভেঙে পড়ে। ম্যাচ জিতলেও এত যন্ত্রণা হচ্ছিল হাঁটুতে! সেমিফাইনাল ম্যাচের আগে ওকে আধ ঘণ্টা পেপটক দিয়েছিলাম। তার পর থেকে এখন পর্যন্ত ও শুধু একটা ম্যাচ হেরেছে। মন্টেকার্লো ফাইনালে জকোভিচের কাছে।”
আট বছর আগে রোলাঁ গারোয় আবির্ভাব থেকে রবিবার পর্যন্ত সেখানে নাদালের জয়-হার ৫৯-১। কেরিয়ার-খতমের ভয় দেখানো চোট থেকে সেরে উঠে সাত মাস পর কোর্টে ফিরে জয়-হার ৪৫-২! দু’টো পরিসংখ্যান রাফায়েল নাদালকে অতিমানবিক স্তরে তুলে দিয়েছে। এ রকম ভাইপোর সাফল্য দেখে কাকার চোখ তো আনন্দাশ্রুতে ভাসবেই! নাদালের জকোভিচ-বধ দেখে এ বার রোলাঁ গারোর প্লেয়ার্স বক্সে যে রকম কাঁদতে দেখা গিয়েছে টনি নাদালকে। |
সর্বকালের সেরা |
রড লেভার ১১ গ্র্যান্ড স্ল্যাম (’৬২-তে অপেশাদার যুগ এবং ’৬৯-এ ওপেন যুগ, দু’বার এক বছরে চারটেই গ্র্যান্ড স্ল্যাম চ্যাম্পিয়ন)
ডোনাল্ড বাজ ৬ গ্র্যান্ড স্ল্যাম (’৩৭-’৩৮ মাত্র দু’বছরে আটটার মধ্যে ছ’টা গ্র্যান্ড স্ল্যাম চ্যাম্পিয়ন)
রজার ফেডেরার ১৭ গ্র্যান্ড স্ল্যাম (২০০৩ থেকে ১০ বছরের মধ্যে ন’বছর মরসুমে অন্তত একটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম চ্যাম্পিয়ন)
|
দাবিদার |
রাফায়েল নাদাল ১২ গ্র্যান্ড স্ল্যাম (একটাই গ্র্যান্ড স্ল্যাম ভেন্যুতে সবচেয়ে বেশি ৮ বার চ্যাম্পিয়ন। মাত্র ছ’বছরে কেরিয়ার গ্র্যান্ড স্ল্যাম পূর্ণ) |
|