প্রবন্ধ ২...
শরীরের নাম মোটেই মহাশয় নয়
স্বাস্থ্য কি এতই অবহেলার? কথাটা গত কয়েক মাস ধরেই মনে হচ্ছে, নানান কারণে। এখন, ঋতুপর্ণ ঘোষ মারা যাওয়ার পর, আরও বেশি করে মনে হচ্ছে। আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আমরা শরীরটাকে বড্ড অবহেলা করি। ঋতুপর্ণ তাঁর শরীরে কী কী অপারেশন করিয়েছিলেন তা আমি বিশদ ভাবে জানি না, অনেকেই হয়তো জানেন না। কিন্তু গত কয়েক বছর সংবাদমাধ্যমে তাঁকে আমরা যে ভাবে দেখেছি তাতে, এবং তাঁর শেষ কয়েকটা সিনেমা দেখে, এটুকু বোঝা যায় যে নিজেকে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে নারী হিসেবে দেখাই ছিল তাঁর ইচ্ছে। নিজে পরিচালক ছিলেন, যে কোনও চরিত্রে সব থেকে মানানসই কাউকে খুঁজে বের করা ছবি পরিচালনা করার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তাই শেষ কয়েকটি ছবির (নিজের বা অন্যের পরিচালিত ছবি) সমকামী বা ছক-ভাঙা চরিত্রে নিজেই অভিনয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অভিনেতা প্রসেনজিৎ-এর ভাষায়: অভিনয় করা নিয়ে বড্ড বেশি অবসেস্ড হয়ে পড়েছিলেন।
শুধুমাত্র তাঁর শেষ সিনেমা ‘চিত্রাঙ্গদা’ একটা ইচ্ছের গল্প ছিল তা নয়, তাঁর নিজের জীবনটাও ছিল একটা ইচ্ছের গল্প। সে ভাবে দেখতে গেলে আমাদের সবার জীবনই কারও না কারওর ইচ্ছা-লাঞ্ছিত, হয় নিজেদের ইচ্ছে, নয়তো আমাদের মা-বাবার, পরিবার-পরিজনের এবং সর্বোপরি সমাজের। কার ইচ্ছেয় আমরা আমাদের জীবনটা কাটাব বা কাটানো উচিত, সেটা এক দিক থেকে খুব জটিল প্রশ্ন— পরিবেশ, পরিস্থিতি, আমরা নিজেরা, মা-বাবারা এবং বাকি সবাই সিঁড়ির কোন স্তরে আছে, ইত্যাদি অনেক কিছুর উপর তার উত্তর নির্ভর করবে। তবে খুব সরলীকরণ করে ঠিক উত্তর দিতে বললে, নিজেদের ইচ্ছে মতন আমরা আমাদের জীবন কাটাব, সেটাই স্বাভাবিক হওয়া উচিত বলে মনে হয়। ঋতুপর্ণও তা-ই করেছেন। কিন্তু ওই অপারেশনগুলো তাঁর শরীরে নিশ্চয়ই মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল, তার সঙ্গে ছিল হরমোন থেরাপির ক্রমাগত ধকল, তদুপরি বছর দশেক ধরে সঙ্গী হয়ে থাকা ডায়াবিটিস। শুভানুধ্যায়ীরা, ডাক্তাররা নিশ্চয়ই সাবধান করেছিলেন, কিন্তু ইচ্ছের কাছে স্বাস্থ্য গৌণ হয়ে গিয়েছিল।
আমাদের ইচ্ছে করে, ভাল লাগে, উদ্বেগ দূর হয়— এই ভেবে আমরা সিগারেট খাই।

সিগারেট আর লাং ক্যান্সারের কার্যকারণসূত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে ১৯৫৭ সালে, ইংল্যান্ড-আমেরিকায়, বিস্তৃত গবেষণার মাধ্যমে। তার পর বহু দেশে বহু স্টাডিতে পাওয়া গেছে যে, যারা সিগারেট খায়, তাদের লাং ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা; যারা খায় না, তাদের তুলনায় সাত থেকে দশ গুণ বেশি (তার মানে অবশ্য এই নয় যে, যারা সিগারেট খায়, তাদের সবার লাং ক্যান্সার হবে)। আর যারা খুব বেশি সিগারেট খায়, ধরুন দিনে পনেরোটার বেশি, তাদের সম্ভাবনা বেড়ে যায় পঁচিশ-ছাব্বিশ গুণ, নন-স্মোকারদের তুলনায়। কোনও মেয়েকে সিগারেট খেতে দেখলে বারণ করে দেখুন, নির্ঘাত শুনতে পাবেন— ছেলেরা খেলে কিছু নয়, মেয়েদের বেলায় যত দোষ— এই গোছের কিছু। তাঁদের নারীবাদী সত্তা প্রধান হয়ে যায়, স্বাস্থ্য গৌণ। সিগারেট শুধু লাং ক্যান্সার নয়, বহু ক্যান্সারেরই অন্যতম রিস্ক-ফ্যাক্টর। সিগারেটটা এড়িয়ে গেলে এই ঝুঁকিগুলো অন্তত কমানো যায়। ক্যান্সারের অনেকটাই এখনও রহস্যাবৃত, কিন্তু ঝুঁকি কমানোর চেষ্টাটা তো করা ভাল।
বন্ধুরা মিলে বাইরে বেরোলে, আমরা নির্বিচারে কোক-পেপসি খাই। টিভিতে দেখা কোকের অ্যাডটা মনে পড়ে যায়— ... খুশিয়া লুটাও। কোকের বোতল খুলে আমরা ভাবি, খুশির উৎসমুখ খুললাম। এই ভাবনাটা দূরে সরিয়ে রাখি যে, এ ধরনের যাবতীয় ড্রিঙ্কস-এ ভর্তি চিনি (সুক্রোস বা হাই ফ্রুকটোস কর্ন সিরাপ) থাকে, যা ক্রমাগত খেতে থাকলে আমাদের ক্যালরি ইনটেক নিয়মিত ভাবে বেড়ে যাবে (কোনও পুষ্টি ছাড়াই), আমরা ধীরে ধীরে মোটা হতে থাকব। আর ওবিসিটি যে কত রোগের প্রধান রিস্ক ফ্যাক্টর, সে হিসেবও তো আজ আমাদের অজানা নয়। এই ধরনের শর্করাসমৃদ্ধ পানীয়গুলো ডায়াবিটিসের প্রকোপও বাড়িয়ে দেয়। এখন আর একটা নতুন চল হয়েছে— ফ্রোজেন খাবার কিনে রেখে দাও যত দিন খুশি, পরে গরম করে খেয়ে নাও। মাল্টিন্যাশনাল ফুড চেনগুলো বিরাট ব্যবসা করছে। এই সব খাবারে প্রচুর পরিমাণে সোডিয়াম থাকে (আমরা যে নুন খাই, তাতেও থাকে)। সোডিয়াম শরীরে রক্তচাপ বাড়ায়। হাই-ব্লাড-প্রেশার রোগীদের হার্ট অ্যাটাক এবং সেরিব্রাল অ্যাটাকের সম্ভাবনা অনেক বেশি। আমাদের কেরিয়ার, ব্যস্ততা, সুবিধা, স্টেটাস সিম্বল প্রাধান্য পায়, স্বাস্থ্য গৌণ হয়ে যায়।
আমরা মুড়িমুড়কির মতো ওষুধ খাই। কাগজে পড়লাম ঋতুপর্ণও খেতেন। ওঁকে খেতে হত হরমোন থেরাপি, ইনসমনিয়া, ডায়াবিটিস ইত্যাদির জন্য। আমরা ভাইরাল ফিভার হলেও ডাক্তারকে বলি অ্যান্টিবায়োটিক দিতে। অনেক ডাক্তারও মনের আনন্দে লিখে দেন রোগী, ওষুধ কোম্পানি এবং তার প্রতিনিধি, সবাই খুশি। অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার এবং যথেচ্ছ ব্যবহার ধীরে ধীরে আমাদের শরীরের ব্যাকটিরিয়ার ড্রাগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে, এক সময় অ্যান্টিবায়োটিক সে ভাবে কাজ করবে না। আমাদের কাছে সাময়িক আরামটাই প্রধান হয় (যেটাও অনেক ক্ষেত্রে হয় না— যা হয়, সেটা নেহাতই একটা প্ল্যাসিবো এফেক্ট, মানে মন-বোঝানো প্রশমন), দীর্ঘকালীন স্বাস্থ্য গৌণ হয়ে যায়। অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স এখন সারা পৃথিবীর জনস্বাস্থ্যের অন্যতম প্রধান সমস্যা। আমাদের দেশে আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞানকে শুধুই ওষুধ এবং কাটাছেঁড়া হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত। রোগ নিবারণের উপর একেবারেই জোর দেওয়া হয় না। যাঁরা ডাক্তারি পড়েন, তাঁদের যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন, ডাক্তারি পাশ করার পর তাঁরা কী করবেন— অধিকাংশই বলবেন যে রোগী দেখবেন (যাঁরা একটু নীতিবাগীশ গোছের, তাঁরা বলবেন রোগীর সেবা করব, গ্রামে যাব ইত্যাদি)। খুব কম ডাক্তারই আমাদের দেশে ভাবেন যে রোগের কারণ নিয়ে গবেষণা করবেন, রোগটা যাতে না হয় তার উপায় বাতলে দেবেন।
এত ক্ষণ যা বললাম, সবই স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যক্তিগত অবহেলার কথা। সরকারি অবহেলার কথা না বললে অন্যায় করা হবে। স্বাস্থ্য খাতে আমাদের সরকার জিডিপি-র কত শতাংশ খরচ করে? দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিক যোজনার আগে পর্যন্ত সংখ্যাটি ছিল এক শতাংশেরও কম। সম্প্রতি অনেক বলে-কয়ে, দ্বাদশ যোজনায় সংখ্যাটাকে দুই শতাংশের কাছাকাছি (যদিও একটু নীচে) আনা গেছে। আমেরিকা বা ইউরোপের যে কোনও উন্নত দেশে অনুপাতটা অনেক বেশি। আমাদের প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে প্রায় চার শতাংশ খরচা করে। কয়েক মাস আগে পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া-র প্রতিষ্ঠা দিবস ছিল। সেখানে শ্রীলঙ্কার এক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ছিলেন প্রধান বক্তা। তিনি তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে দেখালেন, আমাদের প্রতিবেশী দেশটি মা এবং শিশুর স্বাস্থ্য সম্পর্কিত যে কোনও সূচকের ভিত্তিতে আমাদের থেকে বহু যোজন এগিয়ে। আমাদের রাষ্ট্র এখনও আমাদের স্বাস্থ্য নিয়ে যথেষ্ট ভাবিত হল না, তার একটা বড় কারণ কি এই যে, আমরা রাষ্ট্রের উপর যথেষ্ট চাপ দিলাম না, কারণ আমরা নিজেরাই নিজেদের স্বাস্থ্য নিয়ে যথেষ্ট ভাবিত নই? কেবল কাঁড়ি কাঁড়ি ওষুধ খাওয়া মানে কিন্তু স্বাস্থ্যচিন্তা নয়।
আমাদের জীবনে ইচ্ছেটাকে বেশি প্রাধান্য দিতে গিয়ে স্বাস্থ্যকে অবহেলা করার ফলে যেটা দাঁড়াচ্ছে, সেটা খুব একটা স্বাস্থ্যকর হচ্ছে না। বয়স পঁয়ত্রিশ ছুঁতে না ছুঁতেই ডায়াবিটিস, হাই ব্লাড প্রেশার শরীরকে ছুঁয়ে ফেলছে। সেখান থেকে হার্টের রোগ, স্ট্রোক, কিডনির সমস্যা, প্যানক্রিয়াসের রোগ আরও কত কী। ডায়াবিটিস এবং হাই ব্লাড প্রেশারের ক্ষেত্রে একটা অজুহাত খাড়া করার চেষ্টা করা হয় এটা তো বংশগত, কিছু করার নেই। বংশে কারও থাকলে এগুলোর সম্ভাবনা বাড়ে ঠিকই, কিন্তু খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনধারণের পরিবর্তনের মাধ্যমে এগুলোকে সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। স্বাস্থ্যকে অবহেলা করলে শরীর তার শোধ তুলবেই— এটা তো একটা বিজ্ঞান, যার সব কিছু জানা না গেলেও অনেকটাই উন্মোচিত। আমাদের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা না বাড়লে অকাল-অসুখ বা মৃত্যুর জন্য হা-হুতাশ করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না।

পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া’তে কর্মরত


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.