প্রবন্ধ ১...
মেয়েরা যেন কাজের সুযোগ না হারায়
শাহবাগ, হেফাজতে ইসলাম, নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধী পক্ষের নিরন্তর সংঘর্ষের রাজনৈতিক টালমাটালের মধ্যে আরও অনিশ্চয়তা যুক্ত করতে গত ২৫ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল সাভারের দশতলা রানা প্লাজা। মারা গেছেন সহস্রাধিক বস্ত্রশ্রমিক, প্রধানত নারী। বন্যা-ঝড়ে প্রায়শই বিধ্বস্ত বাংলাদেশে এই মৃত্যুর প্রভাব হয়তো সাময়িক হয়েই থাকত, কিন্তু বাংলাদেশের শ্রম ও অর্থনীতির প্রাঙ্গণে এই দুর্ঘটনা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ঘটাতে পারে। কারণ, বাংলাদেশের এই বস্ত্রশিল্প বিদেশি ক্রেতার উপর পুরোটাই নির্ভরশীল এবং এই শিল্পে নারী শ্রমিকদের একচ্ছত্র প্রাধান্য।
বাংলাদেশের দু’হাজার কোটি ডলারের বস্ত্রশিল্পে কাজ করেন ৪৫ লক্ষ মানুষ, যাঁদের ৮০ শতাংশই নারী। এই বিরাট শ্রমিকবাহিনীর অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে। বিশ্ব-বাজারে বাংলাদেশের এই অভাবনীয় উপস্থিতির একমাত্র কারণ চরম দারিদ্র, এত কম মজুরিতে উৎপাদনের প্রতিযোগিতায় চিন, ভারত, শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে বাংলাদেশের উত্থান। কিন্তু গত নভেম্বরে ১১১ জন নারী শ্রমিকের আগুনে পুড়ে মৃত্যু এবং আলোচ্য এই দুর্ঘটনা প্রশ্ন তুলেছে— বস্ত্র শ্রমিকেরা কতটা ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার পান, শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন ব্যতীত কতটা সমাধান সম্ভব, ইউরোপ আমেরিকার ক্রেতাদের সদিচ্ছা কি এই শিল্পে পরিবর্তন আনতে পারে, ইত্যাদি। এই শিল্পে নানা অধিকার দেওয়ার কথা আগেই নাকি ভাবা হয়েছিল, রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর শুধু সেই ঘোষণাগুলি ত্বরান্বিত হয়েছে। এখন ন্যূনতম মজুরির জন্য সব পক্ষকে নিয়ে একটি বোর্ড তৈরি হবে, সবাইকে ব্যাঙ্কের খাতা করে দেওয়া হবে, যাতে নিচুতলার আধিকারিকরা কথায় কথায় মাইনে আটকে বা কেটে রাখতে না পারে। সবচেয়ে বড় কথা, মালিকদের সম্মতি ছাড়াই শ্রমিক সংগঠন করার অধিকার দেওয়া হবে।

নিরাপত্তা চাই। কাজের পরিবেশে উন্নতির দাবি, ঢাকা, মে ২০১৩। ছবি: এ পি
এই বিপর্যয়ের পর অনেকের আশঙ্কা— বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্পের অবস্থা বিদেশি ক্রেতাদের বেআব্রু হয়ে গেছে, সেগুলোকে তারা নিজেদের দেশের একশো বছর আগের কারখানাগুলির মতো বিপজ্জনক মনে করছে। সেই কারণে বিদেশিরা যদি কেনা বন্ধ করে? দেশের বস্ত্র রফতানিকারীরা আশ্বাস দিচ্ছেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। কিন্তু মজুরি বা শ্রমিককল্যাণ বা আর একটু ভাল কাজের পরিবেশ সুনিশ্চিত করতে গেলে তো খরচ বাড়বে, মুনাফা কমবে। তাতে যদি মালিকরা রাজি না হয়? এই শিল্পে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ নেই, বিদেশিরা তৈরি পোশাক কিনে নেয়। বিশ্বের নজরদারির সামনে মুনাফার হার একটু কমার সম্ভাবনা কি মেনে নেবেন বস্ত্রশিল্পের মালিকরা? এত বেশি নারীশ্রমিক নিয়োগ করে যে শিল্প, সেখানে কি তাদের বিশেষ সুযোগের কথা ভাবা হবে? না কি কিছুই বদলাবে না? শ্রমিকের অধিকার ছাড়া কাজ করাটাকেই মেনে নেবেন নারী শ্রমিকরা? তা হলে তো অন্তত কাজটুকু থাকবে।

গত একশো বছরে শ্রমিকদের জন্য সামগ্রিক ভাবে ন্যূনতম মজুরি, সুরক্ষা আর স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বা শ্রমিক সংগঠনের অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে নারী শ্রমিকদের জন্য বিশেষ ভাবে মাতৃত্বকালীন সুবিধা, রাতের কাজে বা ওজন তোলায় নিষেধ থেকে কাজের সময় নারী-পুরুষ বৈষম্য রোধ— এ সবের সুপারিশ হয়েছে। কোথাও কার্যকর হয়েছে, কোথাও নয়। শ্রমিক-অধিকার সমৃদ্ধ পশ্চিম থেকে ক্রমশই শিল্পের ঠিকানা বদল হয়েছে কম মজুরিতে, নানা দেশে। মেয়েদের সুরক্ষা দেওয়াটা ব্যয়সাপেক্ষ। সেই ব্যয় শুধু নিয়োগকর্তাকে বহন করতে হলে নারীশ্রমিক নিয়োগের ব্যয় বাড়ে। সে ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তারা মেয়েদের নিয়োগের পরিবর্তে পুরুষ শ্রমিকদের দিয়ে বা যন্ত্র দিয়ে কাজটা করানোর চেষ্টা করবে, নয়তো মজুরি কমানোর চেষ্টা করবে।
একশো বছর আগে পুরুষের বদলে মেয়েদের কাজে নিয়োগে পারিবারিক কাঠামো ভেঙে পড়ার ভয়ে আর সুরক্ষার নামে, পরিবারের নামে মেয়েদের ঘরে ফেরত পাঠায় শ্রমিক সংগঠন আর রাষ্ট্র। বিশেষ ভাবে ১৯১৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সনদের ৪ নম্বর ধারায় মেয়েদের কাজে অনেক বিধিনিষেধ চাপানো হয়— রাতের শিফটে কাজ নয়, মাটির তলায় কাজ নয়, নির্দিষ্ট ওজনের বেশি তোলা যাবে না, ইত্যাদি। এ সবে কিছু মেয়ে হয়তো স্বস্তি পেয়েছিলেন, কিন্তু এ দেশের কয়লাখনিতে, কাপড়কলে বা বিদেশেও কারখানায় কাজ-করা বহু মেয়ে সেই নিষেধ মানতে চাননি। কাজ গেলে কালকে তাঁরা খাবেন কী? বাজার যেখানে মুখ্য, সরকারি সুরক্ষা যেখানে সীমিত, সবচেয়ে কম দামে উৎপাদন করে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে টেক্কা দেবার লড়াই যতক্ষণ চালাতে হবে, তখন সুরক্ষার বিনিময়ে কর্মী আর শ্রমিকেরা হয়তো কাজটাকেই করতে চাইবেন। তাই মধ্যবিত্ত নারী সদস্যরা যখন খনিতে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে মেয়েদের কাজ করতে দেখে শিউরে উঠে তাঁদের মূল্যবোধ থেকে তা বন্ধ করার সুপারিশ করেন, তখন তাঁদের সেই ‘সু’পরামর্শের জন্য বরাদ্দ থাকে নারী শ্রমিকদের তীব্র কটূক্তি।
আমাদের দেশে যে-সমস্ত মেয়েরা নানান বিপজ্জনক শিল্পে কাজ করেন, সে চম্পাহাটির বাজি কারখানা হোক বা বাড়ির পরিচারিকার কাজ (সেটাও এখন বিপজ্জনক কাজের তালিকায় পড়ে!), তাঁরা অনেকেই সুরক্ষা নেই জেনেই কাজে আসেন, সুরক্ষা আর প্রাপ্তির তুলনামূলক বিচার নিজের মতো করে করেন। আমাদের দেশে মেয়েদের জন্য রাতের কাজ এখনও নিষিদ্ধ— ১৯৪৮ সালের কারখানা আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধনের প্রস্তাব ২০০৭ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় পাশ হলেও এখনও কার্যকর হয়নি। সেখানে শপস্ অ্যান্ড এস্টাবলিশমেন্ট অ্যাক্ট সংশোধন করে মেয়েদের রাতে কাজের ব্যবস্থা করছে। আইটি, খবরের কাগজ, স্বাস্থ্য পরিষেবা, রেল, উড়ান সংস্থা, বিনোদনক্ষেত্র— এ রকম অনেক ক্ষেত্রে বহু দিন থেকেই মেয়েরা রাতে কাজ করেন। কর্নাটক সরকার যখন বিপিওদের জন্য নারী কর্মীদের সম্মতির চিঠি, দিন-রাতের শিফটে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কাজ দেওয়া, সন্তানদের জন্য ক্রেশ আর খেলনার ব্যবস্থা করা, এ রকম আট দফা শর্ত রাখে, তখন কর্নাটক এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন সে রাজ্যের শ্রম দফতরকে আপত্তি জানিয়ে চিঠি দেয়, কারণ তার ফলে বিনিয়োগকারীরা অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছে। আমেরিকার মতো দেশেও মেয়েদের কারখানায় কাজের সুরক্ষাবিধি চালুর প্রথম পর্বে, গত শতকের ষাটের দশকে মেয়েদের কাজের অনুপাত কমে। এখন সে দেশে ছেলেদের কাজে যোগদানের হার কমছে, বাড়ছে মেয়েদের কাজে যোগদানের হার। তার অন্যতম কারণ হল সরকারি সুরক্ষা।
বস্ত্রশিল্পে নারী শ্রমিকদের এই বিপুল সংখ্যায় অংশগ্রহণ বাংলাদেশের সমাজে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে। মেয়েরা ঘরের বাইরে কাজে আসছেন, গ্রাম ছেড়ে শহরে যাচ্ছেন, এক সঙ্গে অনেক ধরনের মেয়ে নিজেদের মতো সময় কাটাতে পারছেন— রক্ষণশীল সমাজ এই সব মেনে নিতে পারছে না। এই সমাজের অনেকেই চান মেয়েরা ঘরে ফিরে যাক। এখন প্রয়োজন সরকার ও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের যৌথ সাহায্য। বাংলাদেশের মালিকদের বুঝতে হবে, এই সোনার হাঁসকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এই উচ্চ মুনাফার লোভ ছাড়তে হবে। পেটে খেলে পিঠে সয় কাজটা তো চালাই, তা হলে বৈষম্যকে আমার মতো করে আমি বুঝে নিতে পারব এক দিন, এটাই কি রানা প্লাজা-পরবর্তী বাংলাদেশি বস্ত্রশিল্পের মেয়েদের স্লোগান? যাতে গলা মেলাবেন এ দেশের মেয়েরাও?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.