ছোটবেলা থেকে দেখছি, বিশেষ এক শ্রেণির মানুষ যখন-তখন যেখানে খুশি হাজির হয়ে ইচ্ছেমতো টাকা দাবি করেন। সেই দাবি তাঁরা কেন করবেন, কোন অধিকারে— এ সব প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই। চলতি কথায় এঁরা ‘হিজড়ে’, ‘বৃহন্নলা’ বা ‘নপুংসক’। আধুনিক ভাষায় ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ বা ‘থার্ড সেক্স’।
কোনও বাড়িতে শিশুর জন্ম হলে হিজড়েরা যা করে, তা এককথায় অভাবনীয়। পরিবার ও পরিস্থিতি অনুযায়ী বিরাট অঙ্কের (চল্লিশ, পঞ্চাশ, সত্তর হাজার— যা খুশি) টাকা চেয়ে বসে এরা। এবং দিতে সম্মত না-হলে কী কী ঘটে, তা-ও অজানা নয় কারও। বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে নপুংসকেরা যে টাকা আদায় করে, তার পিছনে কিন্তু সাধারণ মানুষের কোনও অনুকম্পা কাজ করে না। যেটা কাজ করে, সোজা বাংলায় তাকে বলে ভয়। হেনস্থার ভয়। লোকলজ্জার ভয়। মূক দর্শক হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা পড়শিদের সামনে মানহানির ভয়। এই ভয়ের কারণ আর কিছুই নয়, নপুংসকদের ‘নুইসেন্স ভ্যালু’। গালিগালাজ এবং কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে এরা যে পরিস্থিতি তৈরি করে, তার থেকে পরিত্রাণ পেতেই মানুষ নপুংসকদের টাকা দিতে বাধ্য হন। মানুষের ভয়কে পুঁজি করে দেশজোড়া তোলাবাজির এই ‘নেটওয়ার্ক’ ছিন্ন করতে আজ পর্যন্ত কেন্দ্র বা রাজ্যের কোনও সরকার উদ্যোগী হয়েছে বলে জানা নেই।
হিজড়েদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকাও ন্যক্কারজনক। কেউ যদি নপুংসকদের উৎপাত খেকে বাঁচতে পুলিশকে ফোন করেন, তা হলে অধিকাংশ সময়ে একটাই উত্তর মেলে, ‘নিজেরা মিটিয়ে নিন’। |
সম্প্রতি সল্টলেকের বাসিন্দা এক ভদ্রলোক ছুটির বিকেলে নিজের গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলেন। ট্রাফিক সিগনালে কয়েক জন হিজড়ে এসে তাঁর কাছে টাকা চায়। তিনি দিতে সম্মত না-হওয়ায় তারা সটান তার গাড়িতে উঠে পড়ে। ভদ্রলোক উপায়ান্তর না-দেখে গাড়ি নিয়ে সোজা থানায় চলে যান। থানার পুলিশ তাদের জনা-তিনেককে গ্রেফতারও করে। কিন্তু তার পরেই দেখা দেয় আসল সঙ্কট। ধৃতদের পুলিশ রাখবে কোথায়? পুরুষদের সেলে, না মহিলাদের? তখন বাধ্য হয়েই তাদের বিরুদ্ধে কেস না-দিয়েই ছেড়ে দিতে হয় পুলিশকে। সমস্যাটা এখানেই। আইন আছে অপরাধের। কিন্তু অপরাধী নারী বা পুরুষ না-হয়ে তৃতীয় লিঙ্গের হলে তাকে হেফাজতে রাখার ব্যবস্থা নেই। এই সমস্যা কিন্তু আজ নতুন করে দেখা দেয়নি।
সব থেকে খারাপ লাগে তৃতীয় লিঙ্গের সেই সব মানুষের জন্য, যাঁরা আত্মনির্ভর এবং সম্মান ও মর্যাদার জীবন যাপন করতে চান। নপুংসকদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে যে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে, তা ওই সব নিরপরাধ মানুষকেও ঠেলে দেয় এক ধরনের মানসিক পীড়নের মধ্যে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ মাত্রই যে হাততালি-দেওয়া এবং কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি-করা নয় সেটা সাধারণ মানুষকে বোঝানো সত্যিই খুব কঠিন! যদি বা সেটা তাত্ত্বিক ভাবে বোঝানোও যায়, নপুংসকদের আর পাঁচ জন সাধারণ মানুষের মতো করে দেখাটা সত্যিই কি সম্ভব সেই সব মানুষের পক্ষে, যাঁরা নিজে ওই ধরনের অত্যাচারের শিকার হয়েছেন!
বিভিন্ন বেসরকারি এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দেশের নানা জায়গায় তৃতীয় লিঙ্গের এই সব মানুষকে নিয়ে নানাবিধ কল্যাণমূলক কাজ করে চলেছে। এবং বিশেষত, তৃতীয় লিঙ্গের দুঃস্থ মানুষদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে সেই প্রচেষ্টার সুফলও কিছু কিছু মিলছে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা পূর্ণাঙ্গ নারী বা পুরুষ নন বলে ‘স্বাভাবিক’ জীবনযাপনে অপারগ। আর সেই কারণেই সমাজের এক শ্রেণির মানুষ এঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল। যে সহানুভূতির সুযোগ নিয়েই সম্ভবত হিজড়েরা দিনের পর দিন যা খুশি করেও দিব্যি পার হয়ে যাচ্ছে। তাদের গুরু অপরাধকে লঘু করে দেখা হচ্ছে। কিন্তু স্রেফ লিঙ্গগত বৈশিষ্ট্যের জন্য এক শ্রেণির মানুষ অপরাধ করলে তা আইনের চোখে ‘অপরাধ’ বলে বিচার্য হলেও আইনরক্ষকেরা সেখানে হাত গুটিয়ে বসে থাকেন। কেন? উত্তর কি কোনও দিনই পাব না?
শৌনক মুখোপাধ্যায়। কলকাতা-৬৮ |