|
|
|
|
আঞ্চলিক দলের জোট গড়ার ডাক দিলেন মমতা
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
বিজেপি যখন নরেন্দ্র মোদীকে ২০১৪ সালের নির্বাচনে দলের প্রধান মুখ হিসেবে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ঠিক সেই সময় কংগ্রেস এবং বিজেপি-কে বাদ দিয়ে, বিভিন্ন আঞ্চলিক দলকে মিলিয়েই একটি ‘ফেডেরাল ফ্রন্ট’ গঠনের ডাক দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা আজ বলেন, “এই পক্ষাঘাতদুষ্ট ইউপিএ সরকারকে দেখে মানুষ ক্ষুব্ধ। তাঁরা পরিবর্তন চাইছেন। কংগ্রেসকে তাঁরা প্রত্যাখ্যান করেছেন। কোনও সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গেও মানুষ আপস করতে রাজি নয়। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করার জন্য তাই এখনই একটি আঞ্চলিক ফ্রন্ট গঠন করা জরুরি। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরে তারাই সরকার গঠন করতে পারে।”
তৃণমূল সূত্রের খবর, মমতা বেশ কিছু দিন আগেই এই ফ্রন্ট গঠনের জন্য বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকের সঙ্গেও তিনি যোগাযোগ করতে আগ্রহী। অন্ধ্রপ্রদেশের জেলবন্দি নেতা জগন্মোহন রেড্ডির মায়ের সঙ্গেও মমতার মাঝেমঝ্যেই টেলিফোনে কথা হচ্ছে। ঝাড়খণ্ডের আঞ্চলিক দলের নেতারা মহাকরণে গিয়ে মমতার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করেছেন। আবার নরেন্দ্র মোদীর শপথগ্রহণে কাউকে না পাঠালেও উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে দলের নেতা সুলতান আহমেদকে পাঠিয়েছিলেন তিনি। মমতা ও মুলায়মের মধ্যে যোগসূত্র হয়ে রয়েছেন সমাজবাদী পার্টির রাজ্যসভার সাংসদ কিরণময় নন্দ।
বস্তুত, আঞ্চলিক দলগুলির নেতারাও এক জোট হতে আগ্রহী। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় ইউপিএ-র প্রতি তাঁদের অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে। অন্য দিকে সাম্প্রদায়িকতার কারণে বিজেপি-র থেকেও দূরত্ব বজায় রাখতে চান তাঁরা। নবীন পট্টনায়ক ইতিমধ্যেই বলেছেন, কংগ্রেস এবং বিজেপির সঙ্গে কোনও রকম যোগাযোগ তিনি রাখতে চান না। গত লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি-র সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন নবীন। ভবিষ্যতে রাজ্য বা জাতীয় কোনও স্তরেই যে তাদের সঙ্গে জোট বাঁধবেন না, সে কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি, দুর্নীতির প্রসঙ্গ তুলে ইউপিএ-কে আক্রমণ করার সঙ্গেই রাজনীতিতে রাহুল গাঁধীর কোনও ভবিষ্যৎ নেই বলেও কড়া মন্তব্য করেছেন তিনি। নবীনের মতে, তৃতীয় ফ্রন্ট এনডিএ এবং ইউপিএ-র বিকল্প হতে পারে।
সেই ফ্রন্টটাই গড়তে আগ্রহী মমতা। তার নেতৃত্বে কে থাকবেন, তা অবশ্য এখনও ঠিক হয়নি। কারণ আগে ফ্রন্ট গড়তে হবে, নেতৃত্বের প্রশ্ন আসবে তার পর। মমতা বলছেন, “আমি নেতা হতে চাই না।” কয়েক দিন আগে বর্ধমানের জনসভায় তিনি বলেছেন, “আমি যদি তোমাদের মেয়ে হই, তা হলে ২০১৪ সালে কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করব। কিন্তু আমি কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় যেতে চাইছি, তা নয়। কংগ্রেসের এই জনবিরোধী নীতির অবসানের জন্য ওদের ক্ষমতাচ্যুত করতে চাইছি।”
প্রকাশ্যে তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ার কাজ অবশ্য এখনও শুরু হয়নি। নবীনের কথায়, “এই তো সবে শুরু। এখনও কোনও আলোচনা হয়নি। দেখা যাক ভবিষ্যতে কী হয়।” তলায় তলায় কিন্তু কাজটা শুরু হয়ে গিয়েছে। নীতীশের সঙ্গে এক প্রস্ত আলোচনা হয়েছে মমতার। তার পর মমতার ডাকে সাড়া দিয়ে কলকাতায় একটি অনুষ্ঠানের ফাঁকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছিলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য সে দিন নীতীশের বিমান কলকাতায় পৌঁছতে দেরি হয়। সে দিনই দিল্লি আসার কথা ছিল মমতার। ফলে শেষ পর্যন্ত সেই বৈঠক হয়নি।
নীতীশকে ফের আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন মমতা। কেন্দ্রীয় সরকার পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিকে বঞ্চনা করছে, এই অভিযোগ ইতিমধ্যেই তুলেছেন তিনি। তাঁর ইচ্ছা, পূর্বাঞ্চলের মুখ্যমন্ত্রীদের একটা আঞ্চলিক ব্লক গড়ে যৌথ ভাবে কেন্দ্রের কাছে দাবিদাওয়া তুলে ধরা। সে জন্য কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রীদের একটি সম্মেলনও করতে চান মমতা। সেই সম্মেলনে মুলায়ম বা অজিত সিংহের দলকেও আমন্ত্রণ জানাতে আগ্রহী তিনি। কেন্দ্রের কাছে দাবি জানানোর এই আঞ্চলিক জোটকেই ভবিষ্যতে কংগ্রেস এবং বিজেপি বিরোধী তৃতীয় ফ্রন্টে পরিণত করা যেতে পারে।
তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ার ডাকটা আজ ফেসবুকে দিয়েই দিয়েছেন মমতা। তিনি লিখেছেন, “সমস্ত আঞ্চলিক দলের একজোট হয়ে আসন্ন লোকসভা ভোটে লড়াই করার সময় এসেছে। দেশকে অপশাসন ও জনবিরোধী সিদ্ধান্ত থেকে মুক্ত
করার জন্য, আরও ভাল ও উজ্জ্বল ভারত গড়ে তোলার জন্য আমি সমস্ত অ-কংগ্রেসি, অ-বিজেপি আঞ্চলিক দলকে একজোট হয়ে লড়াই করার জন্য আবেদন জানাচ্ছি। আসুন আমরা এক সঙ্গে দাঁড়াই। এক সঙ্গে কথা বলি। এক সঙ্গে পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের জন্য একটা রূপরেখা তৈরির সিদ্ধান্ত নিই।”
কিন্তু আঞ্চলিক দলগুলি যতই আশাবাদী হোক, কংগ্রেস বা বিজেপি, কারও সমর্থন ছাড়া তাদের পক্ষে কেন্দ্রে সরকার গড়া সম্ভব কিনা, সেই প্রশ্ন থাকছে। অতীতে কখনওই সেটা সম্ভব হয়নি। বামেদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা তৃতীয় ফ্রন্টকে সরকার গড়তে কংগ্রেসের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। এ বারও তেমন কিছু আশা করাটা বাস্তবোচিত নয় বলে কংগ্রেস এবং বিজেপি, দুই শিবিরেরই নেতাদের ধারণা।
তৃণমূলেরও কোনও কোনও নেতার এমনটাই মত। কংগ্রেসের হাত না-ধরলে লোকসভা ভোটে তৃণমূলের ফল যে খারাপ হবে, বিধানসভার তিনটি এবং হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সেইকারণে তৃণমূলের ওই নেতারা বলছেন, লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট না-করলেও আসন সমঝোতা করা উচিত। জোট হলে নীতির বিষয়টি সামনে চলে আসে। কিন্তু আসন সমঝোতা একটা কৌশলগত সিদ্ধান্ত।
মমতা অবশ্য আস্তিনের তাস এখনও বের করছেন না। তাঁর বক্তব্য, সিবিআই এবং বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে বিভিন্ন তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত করানো হচ্ছে, তাঁকে চাপে রাখতে। তাই তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধতে চান না। অন্য দিকে, অধীর চৌধুরী-দীপা দাসমুন্সিরা প্রশ্ন তুলছেন, জোটের ফায়দা তুলে আসন সংখ্যা বাড়িয়ে মমতা পরে এনডিএ-তে চলে যাবেন না, তার নিশ্চয়তা কী? এই অবস্থায় তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, জোটের বিষয়ে মমতাই বা কেন আগেভাগে বলবেন? কংগ্রেস কী চাইছে, সেটাও তো তারা জানায়নি। কংগ্রেসের দিক থেকে যে হেতু কোনও সাড়াশব্দ নেই, তাই মমতাও আগ বাড়িয়ে নিজের তাস দেখাতে চাইছেন না। আপাতত তিনি সিপিএমের পথে হাঁটছেন। সিপিএম একদা যে ভাবে তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ে তুলেছিল, ঠিক সে ভাবেই ফেডেরাল ফ্রন্ট গড়ে তুলতে চাইছেন মমতা। |
|
|
|
|
|