রোজের মতো সে দিনও বঙ্কিম সেতুর উপরে বাসটি গ্যারাজ করে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন চালক-কন্ডাক্টরেরা। সকালে তাঁরা দেখেন, ৭১ নম্বর রুটের ওই বাস উধাও। খবর দেওয়া হয় মালিককে। তার পরে পুলিশে। বহু খুঁজেও বাস উদ্ধার হয়নি। এক দিন পরে তা মেলে বহরমপুর থেকে। রাস্তার ধারে বাস পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয়রা। বাস থেকে মালিকের ফোন নম্বর পেয়ে খবর দেন তাঁরা। মালিক গিয়ে দেখেন বাসের পিছনের চারটি চাকা উধাও। যার দাম ৭০-৮০ হাজার টাকা।
দমদম পার্ক থেকে চুরি যাওয়া ১২সি রুটের বাসের মালিক গৌতম সাহা অবশ্য কেউ ফোন করবে, এই ভেবে ঘরে বসে থাকতে পারেননি। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বাস খুঁজতে। অবশেষে পানাগড়ের কাছে রাস্তার উপরে দেখেন, তাঁর বাস পড়ে রয়েছে। ওই বাস থেকে চুরি গিয়েছে পিছনের দু’টি টায়ার।
শুধু উপরের দু’টি উদাহরণ নয়। গত চার মাসে রাজ্যে বেশ কিছু এমন অভিনব বাস-চুরির ঘটনা ঘটেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চোরেরা বাস চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোনও নির্জন জায়গায়। সেখানে বাসের যন্ত্রাংশ এবং টায়ার খুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে। পড়ে থাকছে শুধু পঙ্গু বাসটি।
উত্তর শহরতলি বাস-মিনিবাস সমন্বয় কমিটি সূত্রের খবর, প্রথম বাসটি চুরি হয় ২রা মার্চ, শনিবার। ওই রাতে অনুষ্ঠান বাড়ি থেকে ফিরে ‘দক্ষিণেশ্বর আইল্যান্ড’ এলাকায় দক্ষিণেশ্বর-বাবুঘাট রুটের বাসটি গ্যারাজ করেন চালক রাজকিশোর শর্মা। রবিবার সকালে এসে দেখেন বাস উধাও। বরাহনগর থানায় ওই ঘটনার অভিযোগ দায়ের হয়। ওই মাসেই মধ্যমগ্রাম এলাকা থেকে ৭৯ ডি, মধ্যমগ্রাম-ধর্মতলা রুটের আর একটি বাস একই ভাবে চুরি হয়। অভিযোগ দায়ের হয় মধ্যমগ্রাম থানায়। কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই পুলিশ চুরি যাওয়া বাস উদ্ধার করতে পারেনি। উত্তর শহরতলি বাস-মিনিবাস সমন্বয় কমিটির সভাপতি গণপতি মজুমদার বলেন, “অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরাই বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে বাসের খোঁজ পুলিশকে দিই। পুলিশ গিয়ে সেই বাস নিয়ে আসে।”
এ রাজ্যে একই কায়দায় অন্তত ৪২টি বাস চুরির ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করেছে জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেট্স। সংগঠনের নেতা তপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “গত কয়েক মাসে প্রায় ৪২টি বাস চুরি গিয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই জেএনএনইউআরএম প্রকল্পের গাড়ি। প্রাথমিক ভাবে আমাদের ধারণা, এখনকার গাড়ির যন্ত্রাংশ, টায়ারের দাম অসম্ভব বেড়ে গিয়েছে। সে কারণেই বাস চুরি করে নিয়ে গিয়ে বাসের যন্ত্রাংশ খুলে বিক্রি করে দিচ্ছে চোরেরা। শুধু পিছনের দু’টি চাকার টায়ার, টিউব এবং অন্য যন্ত্রাংশ বিক্রি করলে প্রায় ৪০ হাজার টাকা আসবে।” বাসমালিক সংগঠন সূত্রের খবর, বেশির ভাগ বাস চুরির ঘটনা ঘটেছে ব্যারাকপুর কমিশনারেট এলাকায়। তা ছাড়া হাওড়া, কলকাতা উত্তর এবং উত্তর শহরতলি এলাকা থেকেও এ ধরনের বাস চুরির ঘটনা ঘটেছে। এমনকী, আমহার্স্ট স্ট্রিট এবং শ্যামপুকুর এলাকা থেকেও দু’টি বাস চুরির ঘটনা ঘটেছে। অন্য দিকে গণপতিবাবু জানান, বেশির ভাগ বাস উদ্ধার হয়েছে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকা থেকে। অভিনব এই চুরির ঘটনায় হাওড়া, ব্যারাকপুর এবং কলকাতা পুলিশ এখনও অথৈ জলে। বাসমালিক সংগঠন সূত্রের খবর, এখনও পর্যন্ত একটি বাসও উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। তবে পুলিশ কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, “প্রতিটি ঘটনার পরে আমাদের মনে হয়েছে এই ধরনের চুরির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বাসের পরিচিত কেউ জড়িত। তবে সব ক্ষেত্রে বাস চুরি করে তার যন্ত্রাংশ ও তেল বিক্রি করাই মুখ্য উদ্দেশ্য।” পুলিশ কর্তাদের কথায়, বেসরকারি বাসগুলি রাতে রাস্তার উপরে যেখানে-সেখানে দাঁড় করানো থাকে। শহর জুড়ে তাই বাসের উপরে নজরদারি চালানো কার্যত অসম্ভব।
তবে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সন্দেহ, এক বা একাধিক চক্র এই চুরির পিছনে কাজ করছে। গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্তা বলেন, “সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চুরির ধরন পাল্টায়। এক সময়ে পকেটমারেরা মানিব্যাগ চুরি করত। এখন মোবাইল চুরির চেষ্টা করে। কারণ, একটা মোবাইল বিক্রি করলে একবারে হাজারখানেক বা তারও বেশি মিলবে। একই ভাবে গাড়ি চুরির ধরন পাল্টাচ্ছে বলে আমাদের প্রাথমিক সন্দেহ।” ওই কর্তা বলেন, “আগে এ ভাবে বাস চুরি করে বিশেষ লাভ ছিল না। এখন কিন্তু বেশির ভাগ বাসই নতুন। যন্ত্রাংশ, টায়ারের দাম আকাশছোঁয়া। তাই বাস চুরি করে দু’টি টায়ার বিক্রি করলেই ২৫-৩০ হাজার টাকা লাভ। অনেক ক্ষেত্রে যন্ত্রাংশ পাচার হচ্ছে ভিন্ রাজ্যে কিংবা বাংলাদেশে। নির্দিষ্ট এলাকা ধরে একই কায়দায় এই চুরি হচ্ছে বলে আমাদের সন্দেহ, এর পিছনে সংগঠিত অপরাধ-চক্র যুক্ত থাকতে পারে।”
তপনবাবুর বক্তব্য, “বিষয়টি নিয়ে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। তিনি পুলিশ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।”
|