শিয়ালদহে সূর্য সেন মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের পরে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল শহরের সব ক’টি বাজারের হাল কেমন, তা ঘুরে দেখতে হবে। রিপোর্ট তৈরি করে পাঠাতে হবে মহাকরণে। সেই কাজটাই করতে গিয়ে এখন চোখ কপালে উঠেছে পুর-প্রশাসনের। শহরের নামী কয়েকটি বাজারের হাল এতই খারাপ যে, খোদ মেয়র পারিষদ (বাজার) তারক সিংহকেও বলতে হচ্ছে, “যে কোনও দিন বাজারের ছাদ বা স্তম্ভ ভেঙে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।” বাজারগুলির হাল তাই ভাবিয়ে তুলছে পুরকর্তাদেরও।
সূর্য সেন মার্কেটের আগুনে ২১ জন মারা গিয়েছিলেন। তার পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কড়া বার্তা পৌঁছয় পুরসভায়। বাজারের হাল নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হয়। পুর সূত্রের খবর, শহরের ৩৫৮টি বাজারের মধ্যে পুরসভার ৪৬টি। বাকি বেসরকারি। সেগুলোর অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিয়ে সমীক্ষা করে মহাকরণে রিপোর্ট পাঠিয়েছে পুরসভা। সম্প্রতি মেয়র পারিষদের নেতৃত্বে পুরসভার বাজার দফতরের একটি দল বাজার ভবনগুলোর হাল দেখা শুরু করেছে। |
শ্যামবাজার বাজারের ভগ্নপ্রায় বাড়ির মাথায় বিজ্ঞাপনের বোঝা। |
৩০০ বছরেরও বেশি পুরনো উত্তর কলকাতার শোভাবাজার মার্কেট। বাড়িটির দৈন্যদশায় চিন্তিত পুর অফিসারেরা। ১৫০ বছরের পুরনো শ্যামবাজার মার্কেটের হাল দেখে অবিলম্বে সেখানে পুর-আইনের ৪১১ ধারায় বিপজ্জনক বাড়ির নোটিস টাঙানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাজার দফতরের এক অফিসার জানান, এমনিতেই শ্যামবাজার বাজারের বাড়িটির হাল বিপজ্জনক। তার উপরে বাড়িটির মাথায় লোহার কাঠামো লাগিয়ে বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং দিয়েছে কিছু সংস্থা। তাতে আরও ভয়াবহ অবস্থা। ওই সব বোর্ড ভাঙার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঢাকুরিয়ার রামলাল বাজার, যাদবপুরে যাদবগড় বাজার ও উল্টোডাঙা মার্কেটের অবস্থা দেখে রীতিমতো শঙ্কিত পুর-প্রশাসন। তারকবাবুর কথায়, “দুর্বল ছাদ, স্তম্ভগুলো থেকে ইট, সিমেন্ট খসে পড়েছে। ভেঙে পড়লে বড় দুর্ঘটনা ঘটবে। অথচ তার তলাতেই ব্যবসা চলছে। ভ্রূক্ষেপ নেই ক্রেতাদেরও। ” রামলাল বাজারের এক সব্জি ব্যবসায়ীর কথায়, “কী করব বলুন? ঝুঁকি নিয়েই ব্যবসা করতে হয়। পুরসভাকে বলেও কাজ হয় না। ওরা শুধু ভাড়া নিয়েই খালাস!”
রামলাল বাজারের মতোই হাল পার্ক সার্কাস মার্কেটেরও। এটিও পুরসভার নিজস্ব। মাথার উপর থেকে খসে পড়ছে প্লাস্টার। ইট ধসে দেওয়াল ফুটো হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যেই কেনাবেচার ভিড়। ঐতিহ্যশালী নিউ মার্কেটের ফুলবাজারের ছাদও বিপজ্জনক হয়ে রয়েছে। |
ঢাকুরিয়ার রামলাল বাজারের স্তম্ভ থেকে খসে
পড়েছে ইট, সিমেন্ট। এখানেই প্রতিদিন চলে বিকিকিনি। |
খোদ মুখ্যমন্ত্রীর এলাকায় যদুবাবুর বাজারের অবস্থাও তথৈবচ। পুর সূত্রের খবর, ভবানীপুরের ওই বাজারটি প্রতিষ্ঠা হয় রানি রাসমণির আমলে। এক সময়ে তিনিই ছিলেন মালিক। তার পরে বহু বার হাত বদল হওয়া বাজারটির হালও যথেষ্ট খারাপ বলে পুর সুত্রের খবর। পরিকাঠামো উন্নয়নে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকও করে পুর প্রশাসন। কিন্তু বাজারের বর্তমান মালিকপক্ষ তা করতে কতটা উৎসাহী তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এ ব্যাপারে পুরসভার ভূমিকাই বা কী? মেয়র পারিষদ তারকবাবু বলেন, “পুরসভার নিজস্ব বাজারগুলো সারানোর প্রক্রিয়া চলছে। রামলাল বাজার, নিউ মার্কেট, বেহালার এস এন রায় ও পার্ক সার্কাস মার্কেটের কাজ খুব শীঘ্রই শুরু হচ্ছে।” পুর সূত্রের খবর, গত আর্থিক বছরে পুরসভার নিজস্ব বাজার রক্ষণাবেক্ষণে সাড়ে ৮ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে পুরসভার। অর্থাৎ দোকান ভাড়া বাবদ পুরসভা যে টাকা পায়, তার তুলনায় খরচ অনেক বেশি। এই অবস্থায় পুর বাজারের উন্নয়নে আরও টাকা বরাদ্দ করা সম্ভব কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
পুর অফিসারদের যুক্তি, নিজস্ব বাজারগুলোর পরিকাঠামো বদলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে তোলা না হলে লোকসানের অঙ্ক বেড়েই যাবে। মেয়র পারিষদও চান পুর বাজার ভবনগুলির পরিসর বাড়িয়ে আয় বাড়ানোর পথ খোলা রাখতে।
আর জীর্ণদশার বেসরকারি বাজারগুলোর কী হবে?
তারকবাবুর বক্তব্য, “ওই সব বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা হয়েছে। ওঁরা চান পরিকাঠামো বদলাতে। কিন্তু খরচ বহনের দায়িত্ব কে নেবে, তা নিয়ে সকলেই ধন্দে।” এ ব্যাপারে বাজারগুলোর মালিকদের নিয়ে বসা জরুরি বলে মনে করেন পুরকর্তারা। তারকবাবুর মতে, “এ কাজ একমাত্র সম্ভব হবে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপেই।”
|