দীর্ঘ বিরতির পরে কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন (কেএলও) উত্তরবঙ্গে নতুন করে জঙ্গি কার্যকলাপে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে প্রশাসনকে সতর্ক করলেন গোয়েন্দারা। রাঢ়বঙ্গে মাওবাদীরা যখন ফের সক্রিয় হয়ে উঠছে, তখন রাজ্যের একেবারে বিপরীত প্রান্তে কেএলও’র রণ-পরিকল্পনার খবরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের কপালে স্বভাবতই চিন্তার ভাঁজ।
সম্প্রতি রাজ্য গোয়েন্দা শাখা (আইবি)-র তরফে স্বরাষ্ট্র দফতরকে এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, মালদহ ও দার্জিলিং জেলার মূলত রাজবংশী সম্প্রদায় প্রভাবিত এলাকাগুলোয় কেএলও বড় মাপের সশস্ত্র আন্দোলনের তোড়জোড় চালাচ্ছে। এবং আইবি’র আশঙ্কা: ১৯৯৯ থেকে ২০০৩ এই চার বছরে জঙ্গি সংগঠনটি যে ভাবে হিংসা-নাশকতা চালিয়ে প্রায় ৫০ জনের প্রাণ কেড়েছিল, এ বার তার চেয়েও বড় ধরনের হামলা হতে পারে। বস্তুত উপস্থিতি জানান দিতে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগেই কেএলও বড়সড় হামলা চালাতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন গোয়েন্দারা। রাজ্য পুলিশের অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল (আইন-শৃঙ্খলা) বাণীব্রত বসুও কেএলও-র সক্রিয়তাবৃদ্ধির কথা জানিয়ে বলেন, “ওদের কার্যকলাপ সম্পর্কে জেলাগুলোকে সতর্ক করা হয়েছে।”
কিন্তু এত দিন বাদে ‘ওরা’ কী ভাবে ফের সংগঠিত হচ্ছে? রিপোর্টে আইবি জানিয়েছে, গত ২২ মার্চ নেপালের ঝাপা জেলার এক গোপন ডেরায় কেএলও-নেতৃত্ব বৈঠকে বসেছিলেন। সেখানে গড়ে ফেলা হয়েছে সংগঠনের ১৫ সদস্যের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি, যার চেয়ারম্যান জীবন সিংহ, ভাইস চেয়ারম্যান টম অধিকারী ও সাধারণ সম্পাদক কৈলাস কোচ। গোয়েন্দা-রিপোর্টের দাবি: সংগঠন ঢেলে সাজতে গত এক বছর ধরে মায়ানমারে কেএলও’র তিন-তিনটে ‘ব্যাচ’ জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়েছে। প্রথম ব্যাচের ৫০ জনের অধিকাংশ উত্তরবঙ্গের রাজবংশী যুবক, বাকিরা অসমের ধুবুরি ও কোকরাঝোড় জেলার।
গোয়েন্দারা এ-ও জেনেছেন, মায়ানমারে কেএলও-র জন্য জঙ্গি-তালিমের বন্দোবস্ত হয়েছে নাগালান্ডের জঙ্গি-গোষ্ঠী ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অফ নাগাল্যান্ড (খাপলাং গোষ্ঠী)-এর মদতে। ঠিক যেমন অতীতে ভুটান পাহাড়ের প্রশিক্ষণ শিবিরে কেএলও-র পাশে দাঁড়িয়েছিল আলফা। আবার ২০১১-র সেপ্টেম্বরে শিলিগুড়ির প্রধাননগরে কেএলও জঙ্গি ইলিয়াস সরকারকে গ্রেফতার করে কেএলও-মাওবাদী যোগসাজসের ব্যাপারটা পুলিশের গোচরে এসেছে।
বাইরের মদত বা প্রশিক্ষণের পাশাপাশি হাতিয়ার সংগ্রহও চলছে জোরকদমে। আইবি’র দাবি: নেপাল থেকে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ, আইইডি, গ্রেনেড ইত্যাদি চোরাপথে এনে কোচবিহার-জলপাইগুড়ি-দার্জিলিঙের কিছু গোপন আস্তানায় মজুত করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, কেএলও’র চার-পাঁচটা ‘অ্যাকশন স্কোয়াড’ ইতিমধ্যে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে বলে রিপোর্টের হুঁশিয়ারি। গোয়েন্দারা জেনেছেন, অস্ত্রশস্ত্র-গোলাবারুদ কিনতে ইউনিফায়েড কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল (মাওবাদী)-এর সঙ্গে কেএলও’র ১৫ কোটি টাকার চুক্তি হয়েছে, যার সাড়ে পাঁচ কোটি মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই অর্থের উৎস কী?
আইবি-র দাবি: কিছু ব্যবসায়ী-প্রোমোটার-ঠিকাদারের কাছ থেকে নিয়মিত তোলা আদায় করে ছ’মাসে এত টাকা ঘরে তুলেছে কেএলও। ডুয়ার্সের কয়েকটি বিলাসবহুল রিসর্টের মালিকদের থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে। এমনকী, ‘মুক্তিপণ’ মারফত তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কয়েক জন ব্যবসায়ীকে অপহরণও করা হয় বলে আইবি জানিয়েছে।
কেএলও-র ‘নতুন উত্থানের’ জন্য রাজ্যের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর দিকে আঙুল তুলেছেন প্রাক্তন পুর-নগরোন্নয়নমন্ত্রী তথা উত্তরবঙ্গের সিপিএম নেতা অশোক ভট্টাচার্য। তাঁর আক্ষেপ, “গত বিধানসভা নির্বাচনে কেএলও’কে ব্যবহার করেছে তৃণমূল। তাই রাজ্যে নতুন সরকার আসার পরে প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক কোনও দিক দিয়েই ওই জঙ্গিরা বাধা পায়নি।” ভবিষ্যতে এর বড় মাসুল গুণতে হতে পারে বলে অশোকবাবুর আশঙ্কা। এ হেন অভিযোগ অবশ্য মানতে চাননি মমতা সরকারের উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব। “আমাদের নীতি হল এ জাতীয় সংগঠনের লোকজনকে মূলস্রোতে ফেরার সুযোগ করে দেওয়া। কিন্তু কেএলও’র কয়েক জন জেল থেকে বেরিয়ে নেপালে গিয়ে ফের জঙ্গি কার্যকলাপের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেখা হচ্ছে, মুক্তি পেয়েও কেন ওরা ভুল পথে গেল।” বলেন গৌতমবাবু। তবে এই মুহূর্তে উত্তরবঙ্গে কেএলও-ই যে বড় বিপদ, সেটা মানতে তিনি দ্বিধা করছেন না।
কম তথ্য তো পুলিশ হাতে পায়নি! সম্ভাব্য কেএলও-হানাদারি প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা হচ্ছে? রাজ্য পুলিশ আশার বাণী শোনায়নি। বরং কিছুটা অসহায়ই শোনাচ্ছে রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তার স্বর “খুব গোপনে ওরা কাজ চালাচ্ছে। ফোন ব্যবহার করছে অসম ও নেপালে। ওদের গতিবিধি অনুসরণ করতে সমস্যা হচ্ছে।”
অতএব কেএলও নিয়ে আশঙ্কার মেঘও ঘনীভূত হচ্ছে পুলিশ-প্রশাসনের অন্দরে।
|