আজও ছায়া অনাহারের
হাতে কাজ নেই, মদে মজে আছে আমলাশোল
পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা প্রান্তিক গ্রামটি শিরোনামে এসেছিল বছর নয়েক আগে।
পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি ব্লক। সেখানেই ২০০৪ সালে অপুষ্টি ও অনাহারে ধুঁকে মৃত্যু হয়েছিল চার শবর-সহ পাঁচ গ্রামবাসীর।
সেই সঙ্গে বেআব্রু হয়ে গিয়েছিল বাম আমলে রাজ্যের অনুন্নয়নের ছবি। আমলাশোল শিরোনামে আসার পরেই পিছিয়ে থাকা গ্রামের তালিকা তৈরি করে অনগ্রসর এলাকা উন্নয়নের জন্য একগুচ্ছ প্রকল্প হাতে নিয়েছিল কেন্দ্র ও রাজ্য। গত প্রায় এক দশকে জঙ্গলমহলের অনগ্রসর এলাকার সার্বিক ছবিটা কতটা বদলেছে? কেমন আছে আমলাশোল? তার কিছুটা আভাস পাওয়া যায় এ বছর (২০১৩) বইমেলায় প্রকাশিত ‘জঙ্গলমহলের আদিবাসী জীবন: আমলাশোলের দিনলিপি’ বইটিতে। লেখক দীপক বড়পণ্ডা এক জন সমাজবিজ্ঞানের গবেষক। প্রায় এক দশক ধরে তাঁর আমলাশোলে নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত আমলাশোল সংক্রান্ত নানা সংবাদ ও প্রবন্ধের অংশবিশেষ ও তথ্য উল্লেখ করে তিনি আলোচনা করেছেন।
লেখকের অনুভব, ‘প্রান্তিক দরিদ্র দুর্বল মানুষগুলিকে নানা অভিযোগে বিধ্বস্ত করা গেলে সহজেই প্রতিবাদের কন্ঠরোধ করা যায়। মাওবাদী-ঘনিষ্ঠ তকমা লাগাতে পারলে তো কথাই নেই।’ সত্যিই তো, বাসিন্দাদের ক্ষমতাহীন করে রাখতে এমন দাওয়াইয়ের জুড়ি মেলা ভার।
২০০৪-এর জুনে আমলাশোলে অনাহারের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখেছিলাম পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা এক দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন জনপদ। যেখানে মানুষ কোনও দিন উন্নয়নের নাম শোনেননি। মুড়া বা মুণ্ডা সম্প্রদায়ের মানুষজন বৃষ্টিনির্ভর সামান্য চাষাবাদ করতেন। শবরদের রুজিরুটি ছিল জঙ্গলকেন্দ্রিক। গত ন’বছরে সরকারি ও বেসরকারি স্তরে বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। তা সত্ত্বেও এখনও শবরেরা জঙ্গলের উপরই নির্ভরশীল। আর তার জন্য দায়ী জমির অসম বণ্টন। এখনও আমলাশোলের শবরদের হাতে চাষজমি নেই। উপযুক্ত সেচের ব্যবস্থাও হয়নি।

বিচ্ছিন্ন। দুর্গম আমলাশোলে যানবাহন চলে না এখনও। —নিজস্ব চিত্র।
সরকারি তথ্য বলছে, কাঁকড়াঝোর থেকে আমলাশোল পর্যন্ত কংক্রিটের রাস্তা হয়েছে। কালভার্ট হয়েছে তিনটি। একশো দিনের প্রকল্পে এবং পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ থেকে গ্রামে তিনটি মোরামের রাস্তা হয়েছে। জলনিকাশি ব্যবস্থা হয়েছে। সেচনালা সংস্কার হয়েছে। গ্রামে নলকূপ বসানো হয়েছে পাঁচটি। পুকুর খনন করা হয়েছে ছ’টি। গ্রামে বিদ্যুতের সংযোগ এসেছে। বেসরকারি সাহায্যে গ্রামে সারা বছর ধরে স্বাস্থ্যশিবির হচ্ছে। আমলাশোলের জন্য আলাদা রেশন দোকান খোলা হয়েছে। একশো দিনের কাজও হচ্ছে। যদিও দেরিতে টাকা আসায় কিছু পরিবারের মজুরি বকেয়া রয়েছে।
এই সে দিন আমলাশোলের বাসিন্দা লক্ষ্মীকান্ত মুড়ার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি জানালেন, এখনও সারা বছর সেচের সুবিধা হয়নি। পাহাড়ি ঝরনার জলগুলিতে বন দফতর চারটি বাঁধ দিয়েছিল। বৃষ্টি হলে তবে নিচু জমিতে সেই জল নামে। সেচ দফতরের উদ্যোগে ২৫ লক্ষ টাকা খরচ করে দুর্গাঝাঁকা ঝরনার জলে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। বৃষ্টি হলে ২০ বিঘে জমিতে সরাসরি সেচের জল পাওয়া যাবে। অর্থাৎ সেই বৃষ্টিই ভরসা।
আমলাশোল এখনও দুর্গম। গ্রাম পর্যন্ত যানবাহন চলে না এখনও। গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। কিন্তু তিন মাসে গড়ে ২৫০০ টাকা বিদ্যুতের বিল আসছে বলে অভিযোগ। হরি মুড়া, রতন মুড়া, শুক্রা শবররা বিল মেটাতে পারছেন না। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, রেশনে মোটামুটি মালপত্র মেলে। বেসরকারি একটি সংস্থা প্রতি দিন আমলাশোলে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা দেয়। গুরুতর অসুস্থদের বেলপাহাড়ি গ্রামীণ হাসপাতাল বা ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে ২৪ জন পড়ুয়া। গ্রামের উপর পাড়ায় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচালিত ‘কেন্দগোড়া আদর্শ শিক্ষায়তন’-এ ৫৪ জন পড়ে। এর মধ্যে ২২ জন শবর শিশু। বেসরকারি উদ্যোগে শিশুদের একটি ক্রেশও হয়েছে।
লেখক জানাচ্ছেন, আমলাশোলে জমির অসম দখলদারির জন্য মুন্ডা বা মুড়া সম্প্রদায় শবরদের তুলনায় অনেকটাই স্বচ্ছল। মুড়ারা পাহাড় কেটে আমলাশোলে চাষজমি তৈরি করেছিলেন। আশির দশকে সেই জমি থেকেই বেশ কিছুটা জমি খাস করে শবরদের পাট্টা দিয়েছিল তৎকালীন বাম সরকার। প্রান্তিক মুড়া সম্প্রদায়ের চাষিরা ওই সব জমি এখনও চাষ করেন। তাঁরা জমির দখল ছাড়তে রাজি হননি। তাই শবরদের হাতে জমির কাগজ থাকলেও আজ পর্যন্ত তাঁরা দখল পাননি। তাই তাঁদের স্থায়ী রোজগারও নেই। জঙ্গলের কাঠ, শালপাতা, কেন্দুপাতা-সহ নানা বনজ সম্পদ সংগ্রহ করে মাইলের পর মাইলের পায়ে হেঁটে পুরুলিয়া অথবা ঝাড়খণ্ডে গিয়ে বিক্রি করতে হয়।
বর্তমানে আমলাশোলে পরিবার আছে ৯১টি। এর মধ্যে ২৫টি শবর পরিবার। জনসংখ্যা প্রায় চারশো। কৃষিকাজের উপরে নির্ভরশীল মাত্র ৭১ জন গ্রামবাসী, তাঁরা কেউই শবর নন। বাকিরা জঙ্গলজীবী কিংবা দিনমজুরি করেন। পরিবারগুলির বার্ষিক আয় ছয় থেকে দশ হাজার টাকা। মাত্র চারটি পরিবার বছরে দশ হাজার টাকার বেশি রোজগার করে।
লক্ষ্মীকান্ত মুড়াদের বক্তব্য, গ্রামে সারা বছর কাজের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। মার্চ পর্যন্ত একশো দিনের কাজ ভালই হয়েছে। তার পরে আর কাজ নেই। ফলে শবরেরা জঙ্গলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। জাঁকিয়ে বসেছে তা হল মদের নেশাও। লক্ষ্মীকান্তবাবুর সাফ কথা, নেশা দূর না করতে পারলে উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই জঙ্গল ধ্বংস আটকানো যাবে।
লেখকও মনে করেন, এখনও আমলাশোলে অনাহারের পরিস্থিতি রয়েছে। স্থায়ী ভাবে অনাহার রোধ করতে দীর্ঘদিনের প্রক্রিয়া চালু রাখতে হয়। সেই প্রক্রিয়ায় একটা বড় অঙ্গ হল শিক্ষা। গ্রামের বেসরকারি স্কুলটির হাত ধরে সেই পরিবর্তন আসছে বলে বইটির শেষ পর্বে লেখক দাবি করেছেন। কিন্তু শিক্ষার পাশাপাশি কর্মসংস্থানও জরুরি। কী ভাবে বিকল্প কর্মসংস্থান সম্ভব? এলাকায় কাজ না থাকায় অনেকেই ভিন্ রাজ্যে শ্রমিকের কাজ করতে পাড়ি দিচ্ছেন। ‘আমলাশোলের দিনলিপি’তে এ বিষয়ে আলোচনার কিন্তু যথেষ্ট সুযোগ ছিল। এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানের গবেষকের প্রস্তাব জানা গেল না।

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.