|
|
|
|
বন্ধুহীন |
ভাল নাটক করেন বুঝি? মঞ্চের সাম্প্রতিক বিতর্কের ঝড়ে আপনার
সম্পর্কগুলোয় ফাটল ধরল নাকি? লিখছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
|
রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত |
‘রাজা লিয়র’কে ঘিরে এত বিতর্ক সৃষ্টি হত না যদি নাটকটাই না হত। আমি এটা মজা করে বলছি না। মিনার্ভা রেপার্টরি থিয়েটার একটা ‘এমব্রায়োনিক স্টেজ’-এ ছিল। তখন দলটাকে গড়ে তোলাটাই সব থেকে বড় এবং একমাত্র কাজ ছিল। সেটা হয়ে গেলে না হয় গেস্ট অভিনেতা বা গেস্ট পরিচালকদের দিয়ে প্রোডাকশন করা যেত।
আমার মনে হয় থিয়েটার কমিউনিটিতে যদি আর একটু ‘ইকোনমিক প্রফেশনালিজম’ আসত, তা হলে হয়তো এ সব হত না। দারিদ্রের ফলে এই সব তুচ্ছ জিনিস নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাটক করবেন সে তো দারুণ কথা। কিন্তু যখন সরকার বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের নিয়ে নাটক করাবে বলে একটা রেপার্টরি গঠন করছে, সেই জায়গাতেও স্টার অভিনেতা আর স্টার পরিচালক থাকলে রেপার্টরির মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যূতি ঘটতে পারে। একাধিক রেপার্টরি থাকলে তো এই সমস্যা হত না। সেই দারিদ্র দূর করাটা সরকারের দায়িত্ব।
তবে বাংলা থিয়েটারের প্রসঙ্গে এটা বলব যে বিতর্ক তো নতুন কোনও ঘটনা নয়। মনে আছে ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটা সেলিব্রেশন হওয়ার সময় প্রথমে সরকার শম্ভু মিত্রকে বলে একটা কাজ করতে। তার পর উৎপলবাবুকে বলা হল রবীন্দ্রনাথের উপর আর একটা কাজ করতে। শম্ভুদাকে তা জানানোও হয়নি। শেষে শম্ভুদা তাঁর কাজটা প্রত্যাহার করেছিলেন। এবং উৎপলবাবুও কাজটা করেননি।
মরাঠি থিয়েটারে দেখেছি যে, যতই বিভেদ থাকুক, সামনাসামনি কেউ কোনও বিতর্কে যায় না। ওঁরা অনেক বেশি পেশাদার। তর্কে গিয়ে বাজে এনার্জি খরচ করে না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের থিয়েটারের ভিত্তিটাই হল আইডিওলজি। অনেকটা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো ব্যাপার। তাই অনেক সময় যে ঝামেলাটা একটা টেলিফোনে মিটিয়ে দেওয়া সম্ভব, সেটা কাগজে উঠে আসে। আবেগপ্রবণ বাঙালিরা অনেকটা বেশি খুলেই প্রশংসা আর নিন্দে, দু’টোই করে থাকে।
সব কাজের মধ্যেই গণ্ডগোলের লোক থাকে। থিয়েটার যারা আন্তরিক ভাবে করে, তারা সাময়িক ভাবে এ সবে ধাক্কা খেলেও, বেশি দিন তা স্থায়ী হয় না। কারণ থিয়েটার করতে গেলে লোককে ভালবাসতেই হয়। থিয়েটারের মানুষরা বেশি দিন ভুল বুঝে থাকতে পারে না। |
|
বিভাস চক্রবর্তী |
সম্পর্ক টিকবে কি না এটা নির্ভর করে ব্যক্তির উপরে। আমি মনে করি, বন্ধুত্বের হানি হয় না। অনেকের সঙ্গে আমার বিরোধিতা রয়েছে। থিয়েটার নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে। কিন্তু সম্পর্ক খারাপ হয়নি। যদি না সে আমার থেকে নিজেই দূরে চলে গিয়েছে। মনে পড়ছে সুনীলদার সঙ্গে একটা ঘটনা। উনি বহুরূপী প্রযোজিত ‘রক্তকরবী’ সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছিলেন। আমি তার পর একটা চিঠি লিখি আনন্দবাজার পত্রিকাতে। সেখানে আমি আমার মত স্পষ্ট করেই বলেছিলাম। আমার চিঠি লেখার পরে সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় আর কৌশিক সেনও চিঠি লিখেছিল। পরে একটা মিটিংয়ে সুনীলদার সঙ্গে দেখা। পাশ থেকে কেউ মনে করিয়ে দেন আমার ওই চিঠি লেখার ব্যাপারটা। কিন্তু সুনীলদা বলেছিলেন, ‘‘ও নিজের মত প্রকাশ করে ভাল করেছে।”
আর এক বার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-র লেখা ‘দুঃসময়’-এর রিভিউ করতে বলা হয়েছিল আমাকে। আনন্দবাজারে। আমি একটু বেশি কড়া রিভিউ লিখেছিলাম। তীব্র ভাষায় লিখতে আমি অভ্যস্ত। লেখাটা প্রকাশিত হওয়ার পর বুদ্ধদেবের সঙ্গে সম্পর্কটা সাময়িক ভাবে হয়তো নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কোথাও আমার সঙ্গে দেখা হলে উনি প্রায় আমাকে না দেখেই চলে যেতেন। পরে সম্পর্কটা সহজ হয়ে আসে।
আর এক বার আনন্দবাজারে একটা পোস্ট-এডিট লিখেছিলাম। হেডিং ছিল ‘আইস আমরা কমার্শিয়াল হই’। হয়তো না বুঝেই কৌশিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে একটা লেখা পাঠায়। তবে তার পরও কৌশিকের প্রতি আমার যে স্নেহ ছিল, সেটা আজও রয়েছে। ও, ওর ‘ম্যাকবেথ’, ‘থানা থেকে আসছি’ দেখতেও বলে। ‘রাজা লিয়র’-এর ক্ষেত্রেও সম্পর্ক নষ্ট হবে না। |
|
গৌতম হালদার |
আমরা একটা মন নিয়ে চলি। এই বিভাজনগুলো যখন তৈরি হয়, তখন যতই আমাদের মনে হয় যে আমরা থিয়েটার কর্মী, সেখানেও একটা বিভাজন কাজ করে। হল পাওয়া, নিরপেক্ষ ভাবে সবাইকে বলা যে একটা থিয়েটার ভাল হয়েছে সেগুলোতে বাধা আসে। একটা ব্যক্তিগত বিচ্ছিনতা তৈরি হয়। চার পাশেই দেখছি যে থিয়েটারে বিভাজন তৈরি হয়েছে। ব্যক্তিগত আলোচনায় শুনেছি অনেকের ক্ষোভ আছে। যার ক্ষমতা বেশি, যোগাযোগ বেশি, অনেক ক্ষেত্রে কাজের থেকে তাকে মূল্য বেশি
দেওয়া হয়।
এটা বেশ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। আমরা যদি একে অপরের কাজকে খোলা গলায় প্রশংসা করতে না পারি, তা হলে তো থিয়েটারের সামগ্রিক ক্ষতি হবে। ব্রাত্য বা সুমন, এদের কারও সঙ্গেই আমার বিরোধ নেই। বন্ধুত্ব থাকলেও মতামতের তফাতও হয়েছে। দু’জনেই আমার থেকে বয়সে ছোট। শ্রদ্ধা করি ওদের কাজকে।
এ কথা ঠিক যে থিয়েটারের মধ্যে বেশ কয়েকটা সংগঠন তৈরি হয়েছে। অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় হয়তো অনেক ভাল কাজ করছে এখানকার নাট্যকর্মীরা। এই সুসময়টাকে বিচ্ছিন্নতার কারণে নষ্ট হতে দেওয়া উচিত নয়। |
|
চন্দন সেন |
যে ধরনের ভাষায় কথাবার্তা হচ্ছে, তাতে মনে হয় না যে এর পরে সুস্থ সম্পর্ক থাকবে। যেটা ‘ওভার-দ্য-টেবল’ হতে পারত, সেটা এ ভাবে কাগজে নগ্ন ভাবে তুলে ধরলে সম্পর্কে চিড় ধরবেই। এ সবের মধ্যে একটা রাজনৈতিক চাপান-উতোর আছেই। তা সে যতই সযত্নে ঢাকার চেষ্টা করা হোক না কেন। মতামতের সংঘর্ষের থেকেও স্পষ্ট হল রাজনৈতিক সংঘর্ষ। সৌজন্য হয়তো থাকা সম্ভব। কিন্তু বন্ধুত্বের গভীরতাও থাকবে না। হেসে কথা বলা যাবে। নাটক যদি ভাল হয়, মুক্ত কণ্ঠে প্রশংসা করা যাবে। তবে এ সবের আগে, কোনও কোনও বিশেষ মুহূর্ত, ইচ্ছে করত কিছু মানুষের সঙ্গে শেয়ার করতে। সেই মনে হওয়াটা আর সম্ভব নয়। খুব ব্যক্তিগত স্তরে শেয়ার করা যেত কিছু কথা। এটাই বন্ধুত্বের শতর্। কিন্তু সেই নির্ভরতার জায়গা চলে গিয়েছে। |
|
দেবশঙ্কর হালদার |
‘রাজা লিয়র’ নিজেও তো বলেছেন যে আর কোনও পিতা যেন সন্তানকে না ভালবাসে! তার মানে কি উনি সত্যি ওটা বলতে চেয়েছিলেন? আমি নিজে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে অভিনয় করি। তাই জানি যে সব সময় মতের মিল নাও হতে পারে। সেটা মাথায় রেখেই চলতে হয় আমাদের।
আমরা যারা থিয়েটার না করে পারি না, তারা জানি যে কোনও তুচ্ছ বিতর্কে আমাদের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত নয়। এত রকমের লোকের সঙ্গে আমরা কাজ করি। ঝগড়াঝাঁটি হলেও, শিল্পের তাগিদে তো আমাদের এ সবের উর্ধ্বে উঠতেই হয়। সাময়িক ভাবে হয়তো একটা অসুবিধা হতে পারে।
কিন্তু সাম্প্রতিক উষ্মাটা কেটে গেলে আবার সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। আর একটা কথা বলি। যা ঘটছে তা তো শুধুমাত্র মঞ্চেই হয়, তা নয়। সমাজের সর্বত্রই এটা ঘটে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবধানগুলো সরে যায়। |
|
সোহিনী সেনগুপ্ত |
যখন কেউ সমালোচনা করে তখন ঠিক বোঝা যায় কীসের তাগিদে সেগুলো বলা হয়েছে। কোনটা আসল সমালোচনা, আর কোনটা ম্যালিস, সেটা আমাদের সবার বোঝার ক্ষমতা আছে। গঠনমূলক সমালোচনা সব সময় কাম্য। ব্রাত্যর মতো চিত্রনাট্যকার আর সুমনের মতো পরিচালক পাওয়া বিরল। কাজটা যদি লক্ষ্য হয়, তখন অন্য সব বিতর্ক তুচ্ছ হয়ে যায়। |
|
|
|
|
|