লেখাপড়ার সঙ্গে খেলাধুলোর বিরোধ কি মিটল?
এ বারের মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকের মেধা তালিকা অন্তত তাই বলছে। আগে ভাল ছাত্র বলতে যাঁদের মনে করা হত, তাঁদের কাছে হিন্দি সিনেমা ছিল ব্রাত্য, খেলার মাঠও ছিল নিষিদ্ধ এলাকা। বারো-চোদ্দো ঘণ্টা মুখ গুঁজে পড়াশোনা করার কথাই শোনা যেত তাঁদের মুখ থেকে। কিন্তু এ বারের মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের মেধা তালিকায় যাঁরা স্থান করে নিয়েছেন, তাঁদের সকলেই সেই সাবেক ‘ভাল শিক্ষার্থী’র মতো নন। ব্যতিক্রম বেশ চোখে পড়ার মতো। উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম রামানুজ সিংহ মহাপাত্র আর মাধ্যমিকের প্রথম সৌরাশিস বিশ্বাসের দু’জনেই খেলা পাগল। রামানুজ ক্রিকেট আর সৌরাশিস ফুটবল ভালবাসে। সায়ন্তনী ঘোষ সপ্তম হয়েছেন। তাঁর জীবনের অনেকটা জুড়ে আছে গান-আবৃত্তি-নাচ। এর সঙ্গে আমির খানের সিনেমা হলে তো কথাই নেই। ষষ্ঠ শুভময় চক্রবর্তীরও প্রিয় খেলা ফুটবল। প্রতিদিন বিকেলে হয় ফুটবল নয় তো ভলিবলে ব্যস্ত থাকেন পঞ্চম স্থানে থাকা মৈনাক ঘোষ। ষষ্ঠ স্থানে রয়েছেন কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র সংবর্ত পাল। পড়ার ফাঁকে সুযোগ পেলেই নিয়ম করে ব্যাট হাতে মাঠে চলে যেত সংবর্ত।
কেন? সংবর্তর বক্তব্য, “উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় একটা বিশাল চাপ থাকে। দিনের মধ্যে কিছুটা সময় খেলাধুলো করলে সেই চাপ থেকে কিছুটা অন্তত মুক্ত হওয়া যায়। তা ছাড়া, খেলাধুলো করে ফেরার পরে আমার কিন্তু পড়াশোনায় বেশি মন বসত।” পূর্বস্থলীর মৈনাকও বলেন, “বিকেলে মাঠে না গেলে সারা দিনের পড়াশোনা ভাল হবে না। ফুটবল অথবা ভলিবল কোনও একটা খেলতেই হবে।” প্রায় একই কথা নবদ্বীপ বকুলতলার সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্ত বর্ষণ বিশ্বাসের। তাঁর কথায়, “বিকেলের দিকে আমি কোনও টিউশন রাখিনি, দু’ঘণ্টা মাঠে গিয়ে ক্রিকেট খেলতে না পারলে আমার মাথা কাজ করে না। খুব চেষ্টা করতাম বিকেলের খেলা যাতে বাদ না-পড়ে। তাতে করে রাতের পড়া খুব ভাল হত।”
একই কথা বলেছেন কৃষ্ণনগর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক উৎপল ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “খেলাধুলো করলে যে শরীরটা ভাল থাকে, মনটাও ঝরঝরে থাকে। কিন্তু এখনকার ছাত্রদের খেলার সময়টাকে বেশির ভাগ অভিভাবকই ‘সময় নষ্ট করা’ বলে মনে করেন।” তাঁর কথায়, “কিন্তু সকলকেই বুঝতে হবে যে, খেলাধুলোর সঙ্গে ভাল রেজাল্টের কোনও বিরোধ নেই। বরং উল্টোটাই। আর এ বার মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের কৃতী ছাত্ররা কিন্তু সেটাই প্রমাণ করে দিল। কারণ, তারা সকলেই নিয়মিত খেলাধুলো করত।” শিক্ষক সিরাজুল ইসলামও বলেন, “খেলার মাঠ আসলে চাপমুক্ত করে। তখন সতেজ মনে পড়তে পারে ছেলেমেয়েরা।”
কিন্তু অভিভাবকেরাও সকলে কি তাই মনে করেন? জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তারকনাথ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “পড়ার সঙ্গে খেলার বিরোধটা অভিভাবকেরাই তৈরি করেছেন। সারা দিন বই-এ মুখ গুঁজে কোনও কাজই হবে না, যদি সেটা মাথায় না ঢোকে। আর মাথায় ঢোকাতে গেলে তাজা মনের প্রয়োজন। খেলার মাঠ বা অন্য কোনও বিনোদন মাধ্যম যেটা দিতে পারে। অভিভাবকেরা হয়ত এটা বুঝতে পারছেন। তাই পরিবর্তন ঘটছে তাঁদের মানসিকতার।”
অভিভাবকদের কারও কারও অবশ্য বক্তব্য, উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য কোনও কোনও ছাত্রের সাত থেকে দশ জন গৃহশিক্ষকের প্রয়োজন হয়। সঙ্গে রয়েছে স্কুল ও নিজের পড়াশোনা। তাই খেলার জন্য সময় বার করাটাই দুষ্কর। দ্বাদশ শ্রেণির এক ছাত্রের মা শিপ্রা চৌধুরীর কথায়, “আমার ছেলের বিকেলগুলো ফাঁকা থাকে না। তা ছাড়া কখনও খেলতে গেলে ও ফিরে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সকালে টিউশন, দুপুরে স্কুল, বিকেলে খেলা আবার রাতে টিউশন এবং তার সঙ্গে নিজের পড়াএত ধকল নেওয়া শক্ত।” আর এক অভিভাবিকার বক্তব্য, খেলতে গেলে মনসংযোগ নষ্ট হয়। অন্য নানা দিকে আকর্ষণ বাড়ে। পড়ার বদলে ছাত্র তখন সে সবেই বেশি আকৃষ্ট হয়।
জেলা হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত মনোবিদ দেবাশিস দাশগুপ্ত কিন্তু বলেন, “খেলার মাঠ চাপ মুক্ত হওয়ার সেরা জায়গা। সেই জায়গাটা কেড়ে নেওয়া অত্যাচারের সামিল।” তাঁর কথায়, “খেলাধুলো, সিনেমা দেখা এগুলো স্বাভাবিক জীবনের অঙ্গ। মনে রাখতে হবে, মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকের এই সময়টা বয়ঃসন্ধির সময়। এই সময়ে ছাত্রছাত্রীকে জোর করে শুধু পড়াশোনার গণ্ডিতেই বেঁধে রাখলে, তাকে স্বাভাবিক জীবন থেকে সরিয়ে রাখা হয়। তাতে তার উপরে নেতিবাচক প্রভাবই পড়ে।” |