|
|
|
|
বিনোদন |
চিন্ময় পুকুরে ঝাঁপ দিচ্ছেন,
চোখে ভাসে চপলবাবুর
বরুণ দে • মেদিনীপুর
শিলাদিত্য সেন • কলকাতা |
|
চার দশক পার করল সৌমিত্র-অপর্ণার ‘বসন্ত বিলাপ’। মেদিনীপুর শহরটাও
যেন একটা চরিত্র ছিল সে ছবিতে। শহর বদলে গিয়েছে, তবু ভুলে যায়নি ছবিটাকে। |
“হঠাত্ খেয়াল হল আমাদের জুটিটার কোনও রোমান্স-সিন নেই। খোকাদা আমায় বললেন— তুই কিছু একটা ভেবে ফেল, ডায়ালগও লিখে ফেলতে পারিস তেমন মনে হলে, তারপর আমি সিকোয়েন্সটা সাজিয়ে নেব নিজের মতো করে।” স্মৃতি হাতড়াচ্ছিলেন চিন্ময় রায়, “অত বছর আগের কথা, ঠিকঠাক মনে নেই আর, তবে আউটডোরের কথা জানতে চাইছেন তো, প্রবল ভিড়ে শ্যুটিংয়ে প্রায় না-হওয়ার জোগাড়। সৌমিত্র-অপর্ণা তো বটেই, আমাদের সকলের জন্যেও বললে বোধহয় বাড়িয়ে বলা হবে না, অসম্ভব ভিড় হয়েছিল। কোনও কাজই করা যাচ্ছিল না।”
‘বসন্ত বিলাপ’। চিন্ময়বাবুর ‘খোকাদা’ ওরফে দীনেন গুপ্ত পরিচালিত এ-ছবিতে জুটি হিসেবে অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-অপর্ণা সেন, রবি ঘোষ-কাজল গুপ্ত, অনুপ কুমার-সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়, চিন্ময় রায়-শিবানী বসু। আর ছিলেন তরুণকুমার, হরিধন মুখোপাধ্যায়, কণিকা মজুমদার, আরও অনেকে। “খোকাদার খুব বেশি আউটডোর করার ইচ্ছে থাকলেও ভিড়ের চাপে করা যায়নি। আউটডোর লোকেশন-এর আদত জায়গাগুলোর সেট তৈরি করা হয়েছিল কলকাতার ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে।” স্মৃতিতে ফিরে যান চিন্ময় রায়। |
বসন্ত বিলাপ ছবির বুকলেট। দেবজিত্ বন্দ্যেপাধ্যায়ের সৌজন্যে। |
’৭৩ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘বসন্ত বিলাপ’। চল্লিশ বছরেরও আগে মেদিনীপুরে গিয়েছিল ফিল্মের দল। সে শহর অবশ্য অনেক বদলে গিয়েছে। সেখপুরা চার্চের সামনে সেই পাতা ঝরা গাছটা নেই। কোতবাজারের কাছে সাহাদের বাড়ির পুকুরটাও সংস্কারের অভাবে ধুঁকছে। চতুর্দিকে কচুরিপানায় ছেয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যের পর স্টেশনে যেতে গা ছমছম করে না। রাঙামাটি লেভেল ক্রসিং-এর সামনে এসে আর আটকে পড়তে হয় না, যেমনটা হয়েছিল অপর্ণাকে। উপর দিয়ে চলে গিয়েছে ফ্লাইওভার। এলআইসি মোড়টা দিনভর ব্যস্ত থাকে। আশপাশে ছোট-বড় কত দোকান। মে মাসের চড়া রোদেও রাস্তায় ভনভন করে বাস-লরি-মোটরবাইক। জগন্নাথ মন্দিরের সামনেটাও শুনশান থাকে না। আশপাশে কত বসতি। চল্লিশ বছর আগে শহরের এই জায়গাগুলোই ধরা পড়েছিল ক্যামেরায়। এর সঙ্গেই যেন জড়িয়ে রয়েছে মেদিনীপুরের সেকাল।
এতদিন পরেও ছবিটার কথা উঠলে নস্টালজিক হয়ে পড়েন শহরের প্রবীণ মানুষেরা। যেমন চপল ভট্টাচার্য। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। বাড়ি শহরের হাঁসপুকুর এলাকায়। চপলবাবুর বাড়ির অদূরেই সাহাদের পুকুর, যে পুকুরের সামনে শ্যুটিংয়ে হয়েছিল। একটি দৃশ্যে ক্যামেরায় ধরা হয়েছিল পাড়ের পাঁচিলে উঠে পুকুরে ঝাঁপ মারছেন চিন্ময় রায়। চপলবাবুর মনে পড়ছিল, “শ্যুটিংয়ে দেখতে কত মানুষের ভিড়। সকলেই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কাছ থেকে দেখতে চায়। সেদিনের ছবি আজও যেন চোখের সামনে ভাসে।” |
সাহাদের সেই পুকুর। —নিজস্ব চিত্র। |
পুকুরে ঝাঁপ মারার আগেই চিন্ময়-শিবানীর প্রেমের দৃশ্যটা। “ওই পুকুরপাড়ে বসে শিবানীকে আমি বলব: ‘আমাকে একবার বলো উত্তমকুমার।’ শিবানী তখন আমার দিকে তাকিয়ে বলবে: ‘উত্তমকুমার’। শ্যুটিংয়ে শুরু হল, আমি আমার ডায়ালগ ঠিক বলছি, কিন্তু শিবানী শুধু ‘উত্তমকুমার’ কথাটা কিছুতেই বলতে পারছে না, আর শট এন-জি হয়ে যাচ্ছে। ওদিকে ক্রমশই ভিড় বাড়ছে, শ্যুটিংয়ে বন্ধ হওয়ার জোগাড়। বললাম ‘বি সিরিয়াস শিবানী, আমাদের সিকোয়েন্সটাই কিন্তু বাদ পড়ে যাবে।’ এবারে শিবানী ঠিকমতো বলল। পরে শিবানীকে প্রশ্ন করে বুঝলাম আমাকে ‘উত্তমকুমার’ কল্পনা করে কথাটা বলতে হচ্ছে তো, তাই হোঁচট খাচ্ছিল!” চল্লিশ বছর পরেও চিন্ময় রায়ের স্মৃতিকথনে আশ্চর্য সেন্স অব হিউমার। এই পাড়াতেই বাড়ি জীতেশ হোড়ের। তিনি বলছিলেন, “তখন কলেজে পড়ি। শ্যুটিংয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। মনে আছে, একটা শট দু’বার নেওয়া হয়েছিল। শ্যুটিংয়ে দেখতে প্রচুর ভিড় হয়েছিল।” সে দিনের কথা বলতে গিয়ে নস্টালজিক হয়ে পড়েন প্রাক্তন পুরপ্রধান নাজিম আহমেদও: “মহুয়া সিনেমার সামনে শ্যুটিংয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। তখন শহরটা এত ঘিঞ্জি ছিল না। কিছু রাস্তাই পাকা ছিল। বাকিগুলো কাঁচা। মোরামের। রাস্তার উপর গরুর পাল, ছাগলের পাল ঘুরে বেড়াত।”
সময় পেরিয়েছে। সময়ের সঙ্গে তাল রেখে বদলে গিয়েছে শহরটাও। সন্ধ্যের পর যে স্টেশনে যেতে গা ছমছম করত, এখন তার আশপাশে কত বসতি। সামনে দোকানের সারি। তৈরি হয়েছে নতুন প্ল্যাটফর্ম। যে ওভারব্রিজের নীচে দাঁড়িয়ে অপর্ণার উদ্দেশে সৌমিত্র বলেছিলেন ‘আমি জানতাম তুমি আসবে’, সেই ওভারব্রিজও আর আগের মতো নেই। অদূরে তৈরি হয়েছে নতুন ওভারব্রিজ। পঞ্চাশ হাজার, এক লক্ষ পেরিয়ে শহরের জনসংখ্যা এখন প্রায় দু’লক্ষ। অলিগলির মধ্যেও তৈরি হচ্ছে ফ্ল্যাট। একটু জায়গা পেলেই হল। |
মহুয়া সিনেমা হলের জায়গায় গড়ে উঠছে শপিং মল। —নিজস্ব চিত্র। |
সত্তরের দশকে এই শহরে শুধুই রিক্সাচালকেরা ছিলেন। তেমনই একজন চালক তাঁর রিক্সায় চাপিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে অপর্ণাকে নিয়ে এসেছিলেন স্টেশনে, ট্রেনে ওঠার আগে যদি সৌমিত্রকে ধরা যায়! আজ ছবি তৈরি করলে অপর্ণা উঠতেন অটোতে। বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হয়েছে অটো স্ট্যান্ড, চালু হচ্ছে নতুন নতুন রুট। মেদিনীপুর ফিল্ম সোসাইটির অন্যতম সদস্য সিদ্ধার্থ সাঁতরা বলছিলেন, “সেদিনের শহরের সঙ্গে আজকের শহরের মিলই নেই। প্রায় সব রাস্তাই পাকা। নতুন বসতি, বাজার তৈরি হয়েছে।” বদলেছে শ্যুটিংয়ে স্পটও। এখন কোনও ছবি বা গানের শ্যুটিংয়ে হলে তা হয় গোপগড় পার্ক বা কংসাবতী নদীর ধারে।
এত বদলে স্মৃতিও অবিকল থাকে না, লোপ পেয়ে যায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ঠিক তেমনটিই হয়েছে। “তুমিই বলো, চল্লিশ বছর আগে মাত্র একটা দিনের স্মৃতি মনে রাখা কি সম্ভব?” একটা দিন কেন, জানতে চাই। “আমি অন্তত একদিনের জন্যেই শ্যুটিংয়ে করতে গেসলাম, স্পষ্ট মনে আছে। ওই দিনই যতটা কাজ তোলা সম্ভব, করে নেওয়া হয়েছিল। ভিড়ের কথাই মনে পড়ছে, শ্যুটিংয়ে কী করেছিলাম কিস্যু মনে নেই।” |
|
|
|
|
|