|
|
|
|
|
প্রাথমিক তদন্তে দাবি পুলিশের |
ছত্তীসগঢ়ের নিধনযজ্ঞে
নন্দীগ্রামের চার কন্যা
সুরবেক বিশ্বাস • কলকাতা
|
|
দুই জায়গার মধ্যে দূরত্ব প্রায় হাজার কিলোমিটার। বিরামহীন সড়কযাত্রায় পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম থেকে ছত্তীসগঢ়ের সুকমায় পৌঁছাতে সময় লাগবে অন্তত ১৫ ঘণ্টা।
দুস্তর এই ব্যবধান ঘুচিয়ে এখন যেন মিলে-মিশে গিয়েছে সুকমা আর নন্দীগ্রাম! মাওবাদী দৌরাত্ম্যের সূত্রে।
সুকমায় কংগ্রেস নেতাদের উপরে সাম্প্রতিক মাওবাদী হামলা নিয়ে ছত্তীসগঢ় পুলিশ এবং সিআরপি’র প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে নন্দীগ্রামের নাম। তদন্তকারীদের সন্দেহ, ২৫ মে’র ওই হানাদারিতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল নন্দীগ্রামের সোনাচূড়া গ্রামের চার তরুণী, গত এক বছর ইস্তক যাদের আস্তানা ওড়িশায় মালকানগিরির মাওবাদী-শিবির। উল্লেখ্য, সুকমা-অভিযানে স্থানীয় মাওবাদীদের সাহায্য করতে যে মালকানগিরি থেকে সশস্ত্র ক্যাডারদের বড় দল পৌঁছেছিল, তদন্তের গোড়াতেই তা ফাঁস হয়েছে বলে পুলিশের দাবি।
এবং পুলিশের দাবি অনুযায়ী, সেই ‘মালকানগিরি-স্কোয়াড’-এরই পুরোভাগে ছিল বাংলার চার তরুণী। ছত্তীসগঢ় পুলিশের অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল (নকশাল দমন) আর কে ভিজের কথায়, “সুকমায় কংগ্রেস নেতৃত্বের উপরে আক্রমণে পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশার বেশ কিছু মাওবাদী ক্যাডার জড়িত ছিল, যাদের একটা বড় অংশ আবার মহিলা। এটা আমাদের প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। কিছু নাম পেয়েছি। ওঁদের পরিচয় সম্পর্কে আরও নিখুঁত তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।”
কোনও বড়সড় হামলায় অন্য রাজ্য থেকে ক্যাডার জড়ো করাই মাওবাদী রেওয়াজ। যেমন পশ্চিমবঙ্গের শিলদায় ইএফআর শিবিরে ২৪ জনকে খুনের ঘটনার তদন্তে নেমেও গোয়েন্দারা দেখেছিলেন, আততায়ীদের বড় অংশ এসেছিল ঝাড়খণ্ড থেকে। সাঁকরাইল থানা আক্রমণেও ওড়িশা-ঝাড়খণ্ড থেকে ক্যাডার জড়ো করা হয়েছিল। তবে ভিন্ রাজ্যে মাওবাদী হামলায় সরাসরি বঙ্গজ মাওবাদীদের নাম জড়াল এই প্রথম।
কারা তাঁরা? পশ্চাৎপট কী?
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, সোনাচূড়ার ওই চারটি মেয়ের নাম: ঝর্না গিরি, গীতা সাউ, রাজি গড়াই ও শ্যামলী মণ্ডল। বয়স কুড়ি থেকে পঁচিশ। গোয়েন্দা-দাবি: ২০০৬-এর শেষাশেষি নন্দীগ্রামে যখন ভূমি উচ্ছেদ-বিরোধী আন্দোলনে মাওবাদীরা যুক্ত হয়, তখনই এরা অতি-বাম শিবিরে নাম লিখিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের পুলিশও বরাবর বলে এসেছে যে, ভূমি উচ্ছেদ-বিরোধী আন্দোলনের উত্তুঙ্গ পর্বে সোনাচূড়ায় মাওবাদীরা দুর্ভেদ্য ঘাঁটি বানিয়েছিল, এমনকী সেখানে হাতিয়ার-প্রশিক্ষণও দেওয়া হতো, যার তত্ত্বাবধানে ছিলেন কিষেণজি-তেলুগু দীপক-মধুসূদন মণ্ডল ওরফে নারায়ণের মতো তাবড় মাওবাদী নেতা। ঝর্না-রাজিরা সেখানে অস্ত্রচালনার প্রাথমিক তালিম নিয়েছিল। গোয়েন্দা-সূত্রের খবর: ২০০৭-এর নভেম্বরে সিপিএম নন্দীগ্রামে এলাকা দখলে নামলে (অপারেশন সূর্যোদয়) মাওবাদীরা পিছু হটে। এলাকা ছাড়ে চার তরুণী।
গোয়েন্দারা জেনেছেন, ঝর্না-গীতারা নন্দীগ্রাম ছেড়ে প্রথমে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের মাওবাদী স্কোয়াডে যোগ দেয়। ওখানে তারা সংগঠনের অন্যতম শীর্ষনেতা অর্ণব দাম ওরফে বিক্রমের নেতৃত্বে কাজকর্ম করছিল। তত দিনে চার জনই স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র চালনায় পারদর্শী হয়ে উঠেছে। পরে স্কোয়াডের সদস্যদের সঙ্গে তাদের বিয়ে হয়ে যায়। গত জুলাইয়ে বিক্রম ধরা পড়লে ওই চারটি মেয়ে-সহ অযোধ্যা স্কোয়াডের একাংশকে মালকানগিরিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আপাতত সেখানেই মাওবাদী নেত্রী শুভশ্রী পণ্ডার তত্ত্বাবধানে তারা কাজ করছে বলে পুলিশ-সূত্রের খবর।
উল্লেখ্য, শুভশ্রী পণ্ডা মাওবাদীদের ওড়িশা রাজ্য কমিটির প্রাক্তন সম্পাদক সব্যসাচী পণ্ডার স্ত্রী। গত বছরের মাঝামাঝি সব্যসাচী পার্টিতে ‘দক্ষিণী দাদাগিরি’ ও নির্বিচার হত্যার মতো কিছু নীতির সমালোচনা করে নেতৃত্বকে চিঠি দিয়েছিলেন। পার্টি তাঁকে বহিষ্কার করে। যদিও তাঁর স্ত্রীর দায়িত্ব খর্ব করা হয়নি।
বস্তুত শুভশ্রীর নেতৃত্বে মালকানগিরির স্কোয়াড যে যথেষ্ট সক্রিয়, সুকমা-কাণ্ডে তার ইঙ্গিত পাচ্ছেন গোয়েন্দা-কর্তাদের একাংশ। সিআরপি-সূত্রের খবর: সুকমার ঘটনাস্থল থেকে মালকানগিরির মাওবাদী-ঘাঁটির দূরত্ব বড়জোর চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার। জঙ্গলপথ ধরে এসে সুকমায় ‘অপারেশন’ সেরে ডেরায় ফিরে যাওয়াটা প্রশিক্ষিত গেরিলাদের কাছে তেমন সমস্যা নয়। সিআরপি-অফিসারদের অনেকের অনুমান, ওই দিন মালকানগিরি শিবির থেকে জনা পঞ্চাশ সশস্ত্র মাওবাদী সুকমা-অভিযানে সামিল হয়েছিলেন।
এ দিকে সুকমা-কাণ্ডে জড়িত সন্দেহে সবিতা ওরফে মাধবী নামে এক মাওবাদী নেত্রীকে অন্ধ্র পুলিশ গ্রেফতার করেছে। পুলিশের দাবি: সবিতা মাওবাদীদের বস্তার আঞ্চলিক কমিটির সদস্য, আর তাঁর স্বামী চন্দ্রনানা রয়েছেন মাওবাদী কেন্দ্রীয় কমিটিতে। সুকমার ঘটনার দিনে সবিতা গুলিতে জখম হন। তাঁর মাথার দাম ধার্য হয়েছিল পাঁচ লক্ষ টাকা। খাম্মাম জেলায় নিয়মমাফিক গাড়ি তল্লাশি চালাতে গিয়ে সবিতা জালে পড়েন বলে জানিয়েছে পুলিশ। |
পুরনো খবর: ছত্তীসগঢ়ে খতম সালওয়া জুড়ুমের হোতা, জখম বিদ্যাচরণ |
|
|
|
|
|