দারিদ্র্যের সঙ্গে নিরন্তর লড়াই। সেই যুদ্ধ যে এত দিন হেলায় জিতে এসেছে ওরা। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলই সে কথা জানান দিচ্ছে। তবে সেই রেজাল্ট যেন ঠিক করে দিয়েছে, ফের একপ্রস্থ লড়াইয়ের আবহ। সে কথা ভেবে ভাঁজ চওড়া হয়েছে কৃতী ছাত্রদের বাবা-মায়ের কপালে।
গুপ্তিপাড়ায় গঙ্গার ধারঘেঁষা প্রত্যন্ত গ্রাম চরকৃষ্ণবাটির বাসিন্দা দেবব্রত চক্রবর্তী। ফি-বছর বর্ষায় গোটা এলাকায় জল দাঁড়িয়ে যায়। চাষ নষ্ট হয়। কাদামাখা মাটির পিছল রাস্তা পেরিয়ে যেতে হয় দেবব্রতদের বাড়ি। কৃষ্ণবাটিচর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক দিয়ে সে পেয়েছে ৬০৪ নম্বর। বিজ্ঞান নিয়ে পড়বে ভেবেছে। দু’চোখ জুড়ে স্বপ্ন বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চশিক্ষা করার। কিন্তু খরচের প্রশ্নে অসহায় শোনায় দেবব্রতর বাবা অসিত চক্রবর্তীর গলা। স্বামী-স্ত্রী আর তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে সংসারে মাথা গোঁজার ঠাঁই বলতে টিন আর বেড়ার বাড়ি। মাটি লেপা মেঝে। জোরে বৃষ্টি হলে ছাঁট আসে। ঘরজুড়ে অভাবের ছাপ স্পষ্ট। সামান্য জমি চাষ করে যে আয় হয় তা দিয়ে টেনেটুনেও কুলোতে পারেন কই! দাদা-দিদির মতোই গৃহশিক্ষক ছাড়াই পড়াশোনা করেছে দেবব্রত। দেবব্রতর পাশাপাশি তার দিদি-দাদাও মেধাবী। |
অসিতবাবু বলেন, “এত দিন স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে আরও অনেকে ওদের পড়াশোনায় সাহায্য করেছেন। কিন্তু এ ভাবে কত দিন! এ বারই তো অর্থের অভাবে বোরো চাষ করার ঝুঁকি নিইনি। তিল চাষ করছি।” অসিতবাবুর আক্ষেপ, দরবার করেও বিপিএল তালিকায় নাম ওঠেনি। ছোট ছেলের রেশন কার্ডও হাতে পাননি এখনও।
গুপ্তিপাড়ার গোঁসাইডাঙার কোয়েল ঘোষের প্রাপ্ত নম্বর ৬২৪। ভৌত বিজ্ঞানে সে ১০০-তে ১০০ পেয়েছে। ইংরেজির শিক্ষিকা হতে চায় কোয়েল। তার মেজদি পিয়ালি উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছে। সে চায় ভূগোল নিয়ে পড়তে। বড় বোন পায়েল মামা বিএ পড়ছে।
কিন্তু কোথা থেকে আসবে পড়ার খরচ? বাবা গণেশ ঘোষ খেতমজুর। তিনি জানান, আত্মীয় এবং মেয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা এত দিন পড়ার খরচ অনেকটাই জুগিয়েছেন। টিনের ছাউনির ঘর জীর্ণ হয়ে পড়ায় এক নিকটাত্মীয় ছোটখাট ঘর তৈরি করে দিচ্ছেন। গণেশবাবু বলেন, “আমার রোজগারে সংসারই ঠিক মত চলে না। এত দিন চেয়েচিন্তে মেয়েদের পড়াশোনা হয়েছে। আগামী দিনে কি হবে জানি না।”
কোন্নগরের সায়নকুমার পালের বাবা প্রতিবন্ধী। ট্রেনে লজেন্স বিক্রি করেই যা পান, তাতেই দিন গুজরান। সারা মাসে কত রোজগার হয়, সে প্রশ্নে চোখে বিষণ্ণতা ভরে ওঠে। এসকে দেব স্ট্রিটের টালির ছাউনির ভাড়াবাড়িতে আরও কয়েক ঘর ভাড়াটের সঙ্গে বাস। এই ঘর থেকেই সায়ন মাধ্যমিকে ৫৮১ পেয়েছে। মহাকাশ বিজ্ঞানী হতে চায় সে। |