জীবন জয়ের জেদ
১৪ বছর জেল খেটে মাথা উঁচু করে হাইকোর্টে ওকালতি
তই খারাপ সময় আসুক, সেটাই শেষ কথা নয় জীবনের!
জেল-খাটা আসামি থেকে শুরু করে চেনা-জানা অনেককেই কথাটা বারবার বোঝান গোবিন্দমোহন ঘোষ, ওরফে হারু। নেহাতই কথার কথা নয়। নিজের জীবনে এ কথার মর্ম প্রমাণ করেছেন। খুনের মামলায় দেড় দশক কারাবাসের পরে গোবিন্দ মাথা উঁচু করে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করছেন।
চন্দননগরের বড় ঘরের ছেলে, সাত ভাইবোনের সবার ছোট হারুর এ সব ঝক্কি পোহানোর কথা ছিল না। শখের রাজনীতি, স্প্যানিশ গিটার বাজানোর নেশা আর পড়শি তরুণীর সঙ্গে প্রেমের বাঁধা গতে দিব্যি দিন কাটছিল। ’৮৩-র ২৫ এপ্রিল সব ছক ওলটপালট হয়ে গেল। চন্দননগর কোর্টের মোড়ে দু’জন যুবক খুন হওয়ার ঘটনায় একাধিক অভিযুক্তের সঙ্গে তাঁর নামেও মামলা রুজু হল। এক মাস বাদে আত্মসমর্পণ করে হুগলি জেলা জেলে ঢুকলেন ২৫ বছরের যুবক।
নিজের চেম্বারে গোবিন্দমোহন ঘোষ। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
আজকের মধ্য পঞ্চাশের গোবিন্দ বলছেন, “খুনের মামলায় ধাক্কা খেয়েই মনে হয়েছিল, আইনের রকম-সকম আমাকে জানতেই হবে!” তাই তিন মাস বাদে জামিনে বেরিয়েই সুরেন্দ্রনাথ কলেজে সান্ধ্য বিভাগে আইনের ক্লাসে ভর্তি হওয়া। মাথায় বিচারের খাঁড়া নিয়েই ’৮৬-তে এলএলবি ডিগ্রি। পড়শি মেয়েটির সঙ্গে বিয়ে ওই সময়ই। সেই মেয়ে, গোবিন্দর স্ত্রী লীনা বলছেন, “আমি জানতাম, ওই খুনের সময়ে ও (গোবিন্দ) ঘটনাস্থলে ছিল না। রাজনৈতিক শত্রুতার জন্য ওকে ভুগতে হচ্ছে। তাই কখনওই আমার বিশ্বাস চিড় খায়নি।” বাড়ির ঘোর অমতেও গোবিন্দকে বিয়ে করতে দ্বিধা করেননি লীনা। কিন্তু জীবনটা রূপকথার মতো হল না। সদ্য আইন পাশ করে নিজের মামলা নিজেই লড়তে মুখিয়ে ছিলেন গোবিন্দ। পিছিয়ে এলেন কয়েক জন আইনজীবীর পরামর্শে। নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন হওয়ায় বিয়ের দু’বছরের মধ্যে ফের জেলে গেলেন গোবিন্দ। হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টও গোবিন্দর সাজা বহাল রাখল। জেলেই বন্দিদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ও অন্য অনিয়ম নিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি দিলীপকুমার বসুকে চিঠি লেখেন গোবিন্দ। তখনই বিচারপতির নির্দেশে গঠিত জেল পরিদর্শক কমিটির আহ্বায়ক-সভাপতি, আলিপুর আদালতের অতিরিক্ত জেলা জজ শৈলেন্দ্রপ্রসাদ তালুকদারের নজরে পড়েন তিনি। পরে হাইকোর্টের বিচারপতি হন শৈলেন্দ্রপ্রসাদবাবু। তাঁর কথায়, “কিছু ক্ষেত্রে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ এমন ভাবে সাজানো হয় যে, বিচারকের সাজা না-দিয়ে উপায় থাকে না।” গোবিন্দ প্রসঙ্গে বিচারপতি তালুকদার বলেন, “গোবিন্দ, বিশেষ করে ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়, এর ক্ষেত্রে কিছু ভুল বোঝাবুঝি ঘটেছিল। তা-ই ওঁর জেল থেকে মুক্তিই আমার অভিপ্রেত বলে মনে হয়।”
কিন্তু যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামির ক্ষেত্রে ১৪ বছর সাজা খাটার আগে রাজ্য সরকারের কাছে ক্ষমাভিক্ষা সম্ভব ছিল না। এই সময়সীমা পেরনোর মুখেই রাজ্যের তৎকালীন বিচারসচিব হিসেবে শৈলেন্দ্রপ্রসাদবাবু গোবিন্দর স্ত্রীর আবেদনের ভিত্তিতে হুগলির জেলা প্রশাসনকে বিষয়টি দেখার নির্দেশ দেন। ২০০২-এর ২ অক্টোবর মুক্তি পান গোবিন্দ। এত বছর জেলে থেকে মূলস্রোতে ফিরে আসাটা কত কঠিন, তা গোবিন্দর থেকে ভাল আর কে-ই বা জানতেন! পারিবারিক ব্যবসা, নাকি আইনজীবীর পেশা, কোনটা বাছবেন ধন্দ ছিল। সাহস জোগালেন আইনজীবী তমাল মুখোপাধ্যায়, কিউ এ এম ফিরোজরা। উৎসাহ দেন বন্ধু সূর্য মুখোপাধ্যায়ের মতো কয়েক জন। আইন পাশ করার ১৬ বছর বাদে বার অ্যাসোসিয়েশনে নাম নথিভুক্ত করালেন গোবিন্দ। কালো কোট-গাউন চাপিয়ে এজলাসে অভিষেক হল। অভিষেক শব্দটা অবশ্য পছন্দ নয় গোবিন্দর। হাইকোর্ট পাড়ায় টেম্পল চেম্বারস-এর পাঁচ তলায় নিজের অফিসে বসে বলেন, “জেলেও কিন্তু এটাই করতাম!” সন্ধে হলেই তাঁর সেলে গিজগিজে ভিড় বিচারাধীন বন্দিদের। এক পয়সাও না-নিয়ে জনে জনে মামলার খসড়া তৈরি করে দিয়েছেন। বন্দিদের অনেকের সন্তানের পড়ার ব্যবস্থা করিয়েছেন। অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত আসামি। বন্দির ন্যূনতম অধিকার নিয়ে ধারণা নেই। পরামর্শ দেওয়ার কাজটা করতেন গোবিন্দই।
জেল থেকে মুক্তির এক দশক বাদে এখনও গোবিন্দর বেশির ভাগ মামলাই সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের নিয়ে। এক সময়ে তাঁর জেলের সঙ্গী ছিলেন জামুরিয়ার প্রদীপ ঘোষ। তার হয়ে মামলা লড়েছিলেন গোবিন্দ। দু’দশক বাদে মুক্তি পান প্রদীপ। আসামি গোবিন্দর হয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা লড়েছিলেন রবিপ্রকাশ গুপ্ত। তাঁর কথায়, “যাবজ্জীবন সাজা খাটার পরে কোনও বন্দির এমন প্রতিষ্ঠা লাভ গোটা দেশেই হাতে-গোনা!” আজ তিনি যা হয়েছেন, তার নেপথ্যে জেলের অবদান বারবার স্মরণ করেন গোবিন্দ। কোনও বন্দির থেকে পেয়েছেন মাথা ঠান্ডা রাখার শিক্ষা। কষ্টের মধ্যেও সহৃদয়তার পাঠ নিয়েছেন কারও থেকে। “তবে সব থেকে বড় হল, ধৈর্য আর হার না-মানার শিক্ষা!” বলছিলেন গোবিন্দ। মিতভাষী রোগাটে প্রৌঢ়ের চোখে-মুখে প্রতিকূলতার উজান ঠেলার স্পর্ধা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.