শান্তির আবহে হাইটেক নজরদারিতে রবিবার ভোট দেখল হাওড়া।
বেলা দশটা। নাজিরগঞ্জের পাঁচপাড়া হাইস্কুল। বছর সত্তরের শারীরিক প্রতিবন্ধী শামসুল হক ভোট কেন্দ্রে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে প্রায় কোলে তুলে ভিতরে নিয়ে গেলেন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা জওয়ান। ভোট দেওয়ার পরে ফের একই ভাবে পাঁজাকোলা করে তুলে হুইলচেয়ারে বসিয়ে দিয়ে তাঁকে রাস্তার দিকে এগিয়ে দিলেন সেই জওয়ানই। হতবাক বৃদ্ধ জানালেন, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে ভোট কেন্দ্রে যেতে বরাবরই দ্বিধাগ্রস্ত থাকতেন তিনি। নানা ধরনের অসুবিধাও হত। এ বার সেখানে একেবারে নির্ঝঞ্ঝাটে ভোট দিলেন।
দশটা পঁয়তাল্লিশ। থানামাখুয়া মডেল হাইস্কুল। স্কুলের ছাদে, বারান্দায় লাইট মেশিনগান হাতে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান। স্কুলের মাঠে কড়া নজরদারি রাজ্য পুলিশেরও। এ সবের সঙ্গেই মাঠের সামনে নজরদারিতে নির্বাচন কমিশনের ক্যামেরা লাগানো ভ্যান। ওই ক্যামেরার ছবি সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের অফিসে। স্কুলের সামনে এক সন্দেহভাজন যুবকের ছবি ক্যামেরায় ধরা পড়তেই তাঁকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন রাজ্য পুলিশের কর্তব্যরত কর্মীরা। সদুত্তর না পাওয়ায় ভোটকেন্দ্রের ত্রিসীমানাতেও আর ঘেঁষতে দেওয়া হল না তাঁকে। ক্যামেরা লাগানো এমন দু’টো গাড়ি গোটা হাওড়া সদর লোকসভা কেন্দ্র জুড়ে ঘুরে দিনভর নজরদারি চালায় এ দিন। |
বেলা সাড়ে এগারোটা। দীনবন্ধু ব্রাঞ্চ স্কুল। গেটের মুখেই দুই জওয়ান। স্কুলে ঢোকার মুখে এক যুবকের সচিত্র পরিচয়পত্র দেখতে চাইলেন নিরাপত্তাকর্মীরা। ওই যুবক তা দেখাতে না পারায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল। বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে নিরাপত্তাকর্মীরা ভোটার কার্ড পরীক্ষা করে তবেই ভোটদাতাদের ভিতরে ঢুকতে দিয়েছেন এ দিন। বালি থেকে পাঁচলা পর্যন্ত রাজ্য পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর সমন্বয়েই এই জোরদার নিরাপত্তা ব্যবস্থার দেখা মিলেছে এ দিন। নিরাপত্তা ব্যবস্থা এত আঁটোসাঁটো থাকলেও সকালের দিকে ভোট কেন্দ্রগুলিতে তেমন লাইন দেখা যায়নি। কোনও কেন্দ্রেই ওই সময়টায় লাইনে কার্যত দশ জনের বেশি ভোটার ছিলেন না। তেমন উৎসাহ চোখে পড়েনি নতুন ভোটারদের মধ্যেও। বেলার দিকে ব্যাঁটরার মধুসূদন পাল চৌধুরী স্কুলে দু’এক জন ভোটদাতার দেখা মেলে। একটি বুথে দাঁড়িয়ে ছিলেন জনা তিনেক। তবে দুপুর তিনটের পরে কয়েকটি কেন্দ্রে ভোট দিতে লাইন পড়ে।
হঠাৎ ভোট ঘোষণা হওয়ায় ভোট কম পড়বে, আশঙ্কায় ছিলেন রাজনৈতিক নেতারা। সেই পরিস্থিতি এড়াতে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাওড়ায় গিয়ে সবাইকে ভোট দিতে আসার আবেদন জানান। সরকারি অফিস এ দিন এমনিতেই ছুটি। যে সব বেসরকারি সংস্থা খোলা, তাদের কর্মীরা ভোট দিতে যেতে অফিসের তরফে কোনও অসুবিধার সম্মুখীন হলে যাতে জানাতে পারেন, সে জন্য মমতার নির্দেশে একটি ফোন নম্বরের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস জানিয়ে দেন, ওই নম্বরে ফোন করে অভিযোগ জানালে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। |
২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে বালি ও উত্তর হাওড়ায় সিপিএমের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ এনেছিল তৃণমূল। এ বার হাওড়া সদর লোকসভা উপ-নির্বাচনে সেখানেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ এনেছেন সিপিএম নেতৃত্ব। যদিও সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই দু’টি কেন্দ্র ঘুরে সন্ত্রাসের তেমন কোনও ছবি চোখে পড়েনি। ভোটের হার অবশ্য হাওড়া সদরের বাকি বিধানসভা এলাকার চেয়ে আলাদা ছিল না।
দুপুরে বালিতে এসে রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সারা হাওড়া সদর জুড়ে মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছেন। বালি ও উত্তর হাওড়ায় যেখানে মানুষ সিপিএম-এর সন্ত্রাসের জন্য ভোট দিতে পারতেন না সেখানে এ বার তাঁরা নির্ভয়ে বেরিয়ে এসে ভোট দিয়েছেন।”
এ দিন সকালে বালি ও উত্তর হাওড়ায় কয়েকটি বুথে ভোট শুরুর আগেই ইভিএম মেশিন বিকল হয়ে যায়। ফলে ভোট শুরু হতে দেরি হয়। তবে প্রতিটি বুথেই ছিল কড়া নিরাপত্তা। রাস্তাতেও ছিল পুলিশের টহলদারি। এর মধ্যেই কিছু কিছু জায়গায় বিক্ষিপ্ত কিছু গণ্ডগোলের অভিযোগ তোলে সিপিএম ও তৃণমূল দু’পক্ষই। সকাল দশটা নাগাদ বেলুড় ভোটবাগানে বালি পুরসভার বিরোধী দলনেতা রেওয়াজ আহমেদ ও স্থানীয় সিপিএম কাউন্সিলর মহম্মদ আলাউদ্দিন একে অপরের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ করেন। আবার বিকেলে লিলুয়া পার্টি অফিসে ঢুকে তৃণমূল দুষ্কৃতীরা ভাঙচুর ও মারধর করেছে বলে অভিযোগ করেন সিপিএম প্রার্থী শ্রীদীপ ভট্টাচার্য। শ্রীদীপবাবুর অভিযোগ, উত্তর হাওড়া ও বালি মিলিয়ে ৪৫টি বুথে ভোটারদের তাড়িয়ে দেওয়া, ছাপ্পা ভোট মারা, এজেন্টদের বসতে না দেওয়া, বুথ দখল করা হয়েছে। তিনি জানান, নির্বাচন কমিশনে এ নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন তাঁরা। |