|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
দেশটাকে অন্য ভাবে দেখতে শেখায় |
বড় বাস্কি |
আদিবাসী জীবন ও সংগ্রাম, অরুণ চৌধুরী। গাঙচিল, ২৫০.০০ |
ভারতে আদিবাসীদের ইতিহাস যত প্রাচীন, তাঁদের সম্পর্কে সহনাগরিকদের ধারণা ততই অর্বাচীন। একদল তাঁদের জীবনটাকে কল্পনা করে নেন: শহর থেকে দূরে জঙ্গলের ধারে কোনও এক আদিবাসী গ্রামের নিসর্গ নানা লিখিত, চিত্রায়িত শিল্প-সাহিত্যের উপজীব্য। সেখানে আদিবাসীদের সব ভাল, তারা খুব সরল, বাঁশি বাজায়, গান গায়। তাদের মেয়েরা সহজলভ্য। আর অন্য দল, আদিবাসীদের দেখেন সাপখেকো, ইঁদুরখেকো, পিঁপড়ে বা পিঁপড়ের ডিমভোজী এক বিচিত্র প্রাণী হিসেবে। যেহেতু শুদ্ধ বাংলাভাষীদের সঙ্গে তাঁদের জীবনচর্যার পার্থক্য আছে, অতএব আদিবাসীরা বেচারা! আদিবাসীদের সঙ্গে নৈকট্য থেকে পাওয়া তথ্য ও জ্ঞানের ভিত্তিতে সে সমাজ নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার অভাবের কারণটা স্পষ্ট: তাতে অনেক পরিশ্রম; আদিবাসী জীবনের দুঃখ-কষ্ট-আনন্দ জটিল বুননকে কাছ থেকে দেখা ও আত্মস্থ করায় শ্রমসাধ্য সহমর্মিতা দেখানোটা সহজ নয়। এরই মধ্যে যে-সব প্রামাণ্য কাজ হয়েছে, তাতে অরুণ চৌধুরীর বইটি অবশ্যই এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। ২১টি প্রবন্ধের এই সংকলন পশ্চিমবঙ্গ ও আশপাশের আদিবাসীদের জীবন ও লড়াই নিয়ে সহনাগরিকের মমতায় তথ্যপূর্ণ আলোচনা। এই বইয়ের বিশেষত্ব, এটি প্রচলিত বুদ্ধিচর্চায় আদিবাসী সংস্কৃতি নিয়ে যে বাক্বিস্তার, তার বিপরীতে আদিবাসীদের সক্ষম উন্নয়নের পথ ধরেছে। ‘ওরা পারবে না, ওদের জন্য করে দিতে হবে’ গোছের যে যজমানি উন্নয়নের ধারণা আমাদের সমাজে বিদ্যমান, অরুণ চৌধুরীর লেখাগুলো সম্পূর্ণ উল্টোপথে গিয়ে আদিবাসীদের আত্মশক্তিতে বিকশিত নিজস্ব জীবন গঠনে জোর দিয়েছে।
আদিবাসীদের সঙ্গে অন্যদের যে দূরত্ব, তাতে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ভাষা, কিন্তু অন্য ব্যাপারও আছে, সেটা হল সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা। সংস্কৃতি বলতে সাধারণত নাচ-গান, পুজো-পার্বণ এ সবকেই ধরা হয়। কিন্তু তার বাইরেও তো আছে একটা বড় ব্যাপার অর্থনৈতিক সংস্কৃতি। এই বইতে আদিবাসী সংস্কৃতি তার বৃহত্তর রূপে ধরা পড়েছে। কৃষি উৎপাদন আদিবাসী অর্থনৈতিক সংস্কৃতির একটা প্রধান ব্যাপার, আর কৃষি-সংস্কৃতিতে জমি হল মূল। তাকে কেন্দ্র করে আদিবাসীর জীবনযাপন, তার লড়াই। ব্রিটিশ রাজ ও তার দেশীয় প্রসাদভোগীরা বার বার আদিবাসী জমির উপর থাবা বসিয়েছে। আর বার বার তার বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছে তীব্র সংগ্রাম, যার রসদ সংগৃহীত হয়েছে বৃহত্তর আদিবাসী সাংস্কৃতিক সম্পদভূমি থেকে। অর্থনৈতিক আগ্রাসনের উদ্দেশ্য ও প্রকরণে আক্রান্ত হয়েছে আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস: এমনকি জনগণনার মতো প্রতিষ্ঠানও অনেক সময় আদিবাসীদের স্বতন্ত্র পরিচিতিকে উচ্চবর্ণীয় হিন্দু বিশ্বাসের ধারায় ঢেকে দিয়েছে। জনগণনা বা অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানও তো চালান তাঁরাই, যাঁদের চোখে আদিবাসীরা নিম্নস্তরীয় ‘অপর’। ইংরেজের হাত ধরে আদিবাসীদের তাঁরা বোঝেন ‘ট্রাইবাল’ বলে, যার বাংলা করেন ‘উপজাতি’ এ প্রশ্নটা ভাবেন না যে, তাঁরা কাদের ‘উপ’? পদে পদে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তাঁদের ভাষাটা নিচু, জোর দেওয়া হয় বাংলা, হিন্দি, ওড়িয়াকে নিজের ভাষা হিসেবে গ্রহণ ও ঘোষণা করতে।
অরুণ চৌধুরীর চোখ অন্য রকম তাঁর ভাষা অন্য রকম। তিনি লিখছেন ‘আদিবাসী’ ও ‘জনজাতি’ শব্দ দু’টি, অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে তুলে ধরছেন আদিবাসীর স্বাতন্ত্র্য, যে স্বাতন্ত্র্য স্বীকৃত হয়ে ও বজায় থেকেই দেশ গড়ার কাজে তাঁদের যোগদান সম্ভব ও সম্পূর্ণ হতে পারে। সেই স্বীকৃতির প্রক্রিয়ায় বইতে উঠে এসেছে বিশ শতকের শুরু থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামে রাজ্যের জনজাতীয়দের সক্রিয় ভূমিকা। বিয়াল্লিশের আন্দোলনে বাঁকুড়া, বীরভূম, উত্তর দিনাজপুর, মালদহ ও অন্যত্র জনজাতীয়রা, বিশেষত সাঁওতালরা লড়াই করে প্রাণ দিয়েছেন। আবার ব্রিটিশের বিরুদ্ধে তাঁদের অস্তিত্বের লড়াই, সাঁওতাল হুল, বিরসা মুন্ডার উলগুলান অত্যন্ত তথ্যপূর্ণ ভাবে আলোচিত, যে আলোচনা এসেছে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত টুরকু হাঁসদার সংগ্রামের বিবরণে। এ শুধু ইতিহাসের আলোচনায় জরুরি তা-ই নয়, আদিবাসীদের ইতিহাস গড়বার নিজস্ব গতিপথে এ সব লেখাই পাথেয়। তাঁদের আত্মমর্যাদাসম্পন্ন যে চেতনা, তা আরও জোর পেতে পারে এ থেকে।
মূলবাসীরা ইতিহাসের পাতায় যদিও বা জায়গা পায়, তা খণ্ডিত, বিকৃত। আজ একজন উচ্চ ডিগ্রিধারী সাঁওতাল হিসেবে আমি যখন দেশে-বিদেশে বক্তৃতা করি, তখন রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর নিয়ে যে প্রাবল্যের সঙ্গে অহংকৃত হই, নিজের সমাজ-সংস্কৃতিকে সমান জোরের সঙ্গে তুলে ধরতে গিয়ে প্রথম প্রথম ইতস্তত বোধ করতাম আছে কি আমার বলার মতো কিছু? এটা তো শিক্ষার সীমাবদ্ধতা: যে শিক্ষা পেয়েছি তা আত্মবোধ বজায় রেখে বৃহৎকে গ্রহণ করার শিক্ষা নয়, নিজেকে তথাকথিত ‘বঙ্গীয়’, ‘ভারতীয়’, সমাজ-সংস্কৃতির ছাঁচে ফেলে দেওয়া। বইয়ের পাতায় পেয়েছি বরেণ্য দেশনেতাদের, আর আদিবাসীদের পেয়েছি কেবল ‘সরল, পরিশ্রমী’ জাতি হিসেবে। মাস্টারমশাই বলতেন, ‘বড় হয়ে দিকু হয়ে উঠতে হবে। তা হতে গেলে তোদের ওই হড় ভাষা ছাড়তে হবে, মদ খেয়ে নাচগান ছাড়তে হবে।’ সেটা করতে গিয়ে দেখি পাওয়ার চেয়ে হারানোর পাল্লা অনেক ভারী। আমার মাতৃভাষা এত সমৃদ্ধ, আমার পূর্বজদের সংগ্রামের ইতিহাস এত দীর্ঘ, তবু সে সব ভুলে যাওয়ার শিক্ষা যাঁরা দেন, তাঁরা যে শুধু আদিবাসীদেরই হীন চোখে দেখেন তা-ই নয়, ভারতবর্ষটাকেও নিচু নজরে দেখেন। অরুণ চৌধুরীর বইটা তাঁদেরও হয়তো দেশটাকে অন্য ভাবে দেখাতে শেখাবে।
প্রবন্ধগুলো আগে বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত, ফলে কিছু পুনরুক্তি আছে। লেখকের মার্কসবাদী অনুশীলনে গড়ে ওঠা ভাষা কখনও কখনও একটু ছন্দপতন ঘটায়। ভাষা, শব্দ, শৈলী নিয়ে এ দেশের মার্কসবাদীদের যে সীমাবদ্ধতা, অরুণ চৌধুরীর ক্ষেত্রেও সেটা কিছুটা আছে। সেটা দোষের না হতে পারে, কিন্তু গুণেরও না। সব মিলিয়ে সমাজ ও দেশ নিয়ে চিন্তা-ভাবনার জন্য এ বই অবশ্যপাঠ্য। |
|
|
|
|
|