|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
গাঁধী সম্পর্কে মুগ্ধতা গোপন করেননি |
সেমন্তী ঘোষ |
ফেথ অ্যান্ড ফ্রিডম/ গান্ধী ইন হিস্ট্রি, মুশিরুল হাসান। নিয়োগী বুকস, ৪৫০.০০ |
উনিশশো একুশ সালের পুব বাংলা। কিশোরগঞ্জে পুকুরপাড়ে বিজ্ঞ গ্রামবাসীদের জটলা। চলছে রাজনীতিচর্চা, দেশের নতুন আন্দোলনের ভালমন্দ কাটাছেঁড়া। পুকুরে স্নান করছিলেন এক বয়স্ক ব্রাহ্মণ পৈতেটিকে ভাল করে ধুয়ে পরিষ্কার করছিলেন। আলোচনার গুঞ্জন ছাপিয়ে হঠাৎই শোনা গেল তাঁর উচ্চ চিৎকার: “হিন্দুত্ব-কে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করতেই এসেছেন গাঁধীজি!” ধর্মোন্মাদনায় দীপ্ত ব্রাহ্মণের চোখ, গলায় ভক্তিরসের মাদকতা। পাড়ের জটলার মধ্যে এক জন, যাঁর নাম নীরদচন্দ্র চৌধুরী, মনে মনে ভাবলেন ও অনেক দিন পর দি অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান বইতে লিখলেন, আচ্ছা, গাঁধী নিজে কি খুশি হতেন এ কথা এ ভাবে শুনলে? কী আর করা, গাঁধীর কথা কী ভাবে মানুষ শুনবেন ও বুঝবেন, তার উপর তো আর গাঁধীর তেমন হাত ছিল না!
এটুকু পড়তে পড়তেই হয়তো পাঠকের মনে পড়বে সতীনাথ ভাদুড়ির ঢোঁড়াই চরিত মানস-এর ‘গান্হী-বাওয়া’র কথা, কিংবা সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ’এ শহিদ আমিন-এর ‘গাঁধী’-জনব্যাখ্যার আলোচনা। মুশিরুল হাসান কিন্তু তাঁর নতুন গাঁধী-গ্রন্থে নীরদ চৌধুরীর কাহিনিটি উদ্ধৃত করে সেই সূত্র ধরেই চলে যান গাঁধীর অন্য কিছু (আদর্শগত) প্রতিপক্ষের প্রসঙ্গে। কী ভাবে গাঁধীর নানা তত্ত্ব ও বক্তব্য সম্পূর্ণ বিপরীত গোত্রের মাধুরী মিশিয়ে ব্যাখ্যাত হত, সেই প্রসঙ্গে। যেমন, মাহমুদুজাফর ও তাঁর স্ত্রী রশিদ জাহান, দু’জনেই কড়া কমিউনিস্ট গোত্রের সাহিত্যিক ও সক্রিয় রাজনীতিক, এক দিকে জওহরলাল নেহরুর ডান হাত, অন্য দিকে গাঁধীর নির্মম সমালোচক। তাঁরা বলতেন, গাঁধীর মতো বড় শত্রু ভারতীয় মুসলিমদের আর নেই, তিনি তাদের সঙ্গত দাবিগুলি পর্যন্ত ধর্তব্যের মধ্যে ফেলেন না! উদাহরণও দিতেন তাঁরা, বলতেন কী ভাবে জাতীয় ভাষা প্রসঙ্গে উর্দুর প্রসঙ্গ পর্যন্ত টানতে গাঁধী নারাজ ছিলেন। দেখেশুনে রোম্যাঁ রোল্যাঁর মনে হয়েছিল, নেহরুর পাশে থেকেও কেউ যে গাঁধী বিষয়ে এত বীতশ্রদ্ধ হতে পারেন, সেটা বেশ “curious, rather worrying.” |
|
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ কিন্তু এই গাঁধীরই ব্যঙ্গ-নাম দিয়েছিল ‘মাহমুদ গাঁধী’। এই গাঁধী বিষয়েই মহম্মদ আলি বলেছিলেন, “গাঁধী, গাঁধী, গাঁধী.. মানুষের কানে বার বার এই নাম প্রবেশ করুক, কারণ ‘গাঁধী’ মানেই হিন্দু-মুসলিম ঐক্য, অসহযোগ, স্বধর্ম, স্বরাজ!” গাঁধীর এই নানা বিরুদ্ধপন্থী ব্যাখ্যা কী ভাবে পরবর্তী কালে ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক মত ও পথকে প্রভাবিত করে, সেই পরিচিত বাস্তবেরও আভাস দিতে দিতে চলেন মুশিরুল হাসান। অর্থাৎ, পড়তে পড়তেই পাঠক বুঝে নেন, কাহিনি, ইতিহাস, ব্যাখ্যা আর রাজনীতি কী ভাবে একটি সহজ যোগসূত্রে গাঁথা। গম্ভীর বিশ্লেষণের দরকার হয় না, কতগুলি বর্ণনা ও তথ্য পর পর সাজিয়ে দেওয়ার সূত্রেই পাঠকের কাছে সেই যোগসূত্র পৌঁছে দেন মুশিরুল, যিনি একাধারে সংকলক, বিশ্লেষক, সমালোচক এবং, অবশ্যই, আদ্যন্ত গাঁধীভক্ত ঐতিহাসিক। ফেথ অ্যান্ড ফ্রিডম বইটির এই বর্ণনাত্মক দিকটিই এর সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব। খুব ভুল হবে না যদি এই বিশেষত্বকে আমরা নতুনত্ব বলেও দাবি করি, অন্তত গাঁধী-আলোচনার ঐতিহাসিক ধারাটির ক্ষেত্রে ধরনটা নতুন তো বটেই।
আর, এই নতুনত্বের জন্যই বইটির গোত্রবিচার বেশ কঠিন কাজ। অনেক নতুন তথ্য, নতুন উদ্ধার, কিন্তু তবু এই বইকে সোজাসুজি গবেষণা-গ্রন্থ বলা যাবে না, কোনও অজানা সার-বক্তব্য শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে আসে না। নিছক ইতিহাসও নয়, কেননা সময়কাল/ বিষয়বস্তু ধরে কোনও সংহত ধারায় এগোয় না এই বই, ‘জাতীয় আন্দোলনে গাঁধীর ভূমিকা’ ইত্যাকার বক্তব্যের ধারই ধারে না মোটে, বরং একটা গোটা শতাব্দীর এ দিক ও দিক আগে-পরে যথেচ্ছ বিচরণ করতে থাকে। আবার এলোমেলো হলেও পরস্পর-সংযোগহীন প্রবন্ধ সংকলনও বলা চলে না একে, কেননা বহুমুখী প্রবন্ধগুলির মধ্যে একটি কথা ঘুরে ফিরে আসে: জাতীয় সংগ্রামের প্রেক্ষিতে ভারতের মাটিতে যে সব ভাবনাধারা তৈরি হচ্ছিল, যে সব বিশ্বাস জন্ম নিচ্ছিল, তাদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, এবং গাঁধী ও গাঁধীতত্ত্বের ব্যাখ্যা-প্রতিব্যাখ্যা সেই দ্বন্দ্বের প্রধান চলনভূমি হয়ে ওঠে।
যদিও মূল প্রতিপাদ্য এই কথাটিই, তবে কি না পাঠকের দিক থেকে বইটি তত স্বস্তিদায়ক নয়, বড় বেশি ছড়ানো-ছিটানো। একটিমাত্র অধ্যায়ের মধ্যে কেন তড়িঘড়ি ঢুকে আসে গোটা ব্রিটিশ শাসনের শ’খানেক বছরের ইতিবৃত্ত, যার মধ্যে গাঁধীজি নেহাত ইতিউতি ছড়িয়ে? পরের কয়েকটি অধ্যায়ে কেনই-বা এতগুলি বিষয়ের এত বিচিত্র তথ্য: কংগ্রেসের উত্থান ও বৃদ্ধি, কৃষক-শ্রমিকদের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্কের ওঠা-পড়া, সত্যাগ্রহের সমস্যা, প্রাদেশিক মন্ত্রিসভাগুলির কর্মপদ্ধতি, স্বাধীনতা ও দেশভাগের কুনাট্য? কেনই-বা কখনও গাঁধী উপস্থিত পুরো মাত্রায়, কখনও নিতান্ত প্রচ্ছন্ন? গাঁধীর উপর যে সব বই প্রভাব ফেলেছিল সেগুলির কথা পড়ে চলি, যে সব মানুষ গাঁধীর প্রিয় ছিলেন কিংবা গাঁধী যাঁদের প্রিয় ছিলেন, তাঁদের কথা, তাঁদের নিজেদের ইতিহাস, তাঁদের বক্তব্য। দেশি বিদেশি হিন্দু মুসলিম রাজনৈতিক সাহিত্যিক সমাজকর্মী, কে নেই সেই তালিকায়! কারও জন্য বরাদ্দ অনেকগুলি পৃষ্ঠা, কারও জন্য মাত্র দেড় পৃষ্ঠা। মীরাবেন বা সি এফ অ্যান্ড্রুজ-এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের চমৎকার ছবি যেই ফুটে উঠতে শুরু করে, হঠাৎ করেই থেমে যায় সে-ছবি: ফলে সম্পর্কের প্রেক্ষিতটি যেমন স্পষ্ট প্রকাশিত হয়, সম্পর্কের গতি বা বিকাশটি তত বোঝা যায় না, আফশোস থেকে যায়। সকলকে সমান জায়গা দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না, কিন্তু এতখানি বিষমতা বা অসংহতি দিয়েও কি পাঠককে সন্তোষ দেওয়া যায়?
যেখানে কার্পণ্য ঘটে না, তেমন কয়েকটি অধ্যায় অবশ্য অসামান্য হয়ে ওঠে। যেমন, নেহরুদের সঙ্গে গাঁধীর সম্পর্ক, কিংবা গাঁধীর মুসলমান-ভাবনা। দুটি বিষয়ই অতি-চর্চিত, কিন্তু এই দুটি অধ্যায়ই সেই চর্চায় অতি মূল্যবান সংযোজন। এই অধ্যায়গুলি বুঝিয়ে দেয় ঐতিহাসিক হিসেবে মুশিরুল হাসানের উৎকর্ষ কতখানি।
সেই উৎকর্ষ আরও লক্ষণীয় হয়ে ওঠে যখন দেখি ঐতিহাসিকের দায়টি তিনি পালন করেন গবেষক-সুলভ নিস্পৃহতার ধার না ধেরেই। এই বই-এর সব ক’টি ছত্রে ছড়ানো রয়েছে গাঁধী সম্পর্কে তাঁর মুগ্ধতা, যাকে ভক্তি বললে অত্যুক্তি হয় না। কিন্তু ব্যক্তিসাপেক্ষতা-বিহীন ইতিহাসই যদি প্রাচীন কালের বস্তু বলে নির্ধারিত হয়ে যায়, তবে নিস্পৃহ গবেষণার প্রয়োজনই বা কী! বরং গাঁধী সম্পর্কে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত রচনাশৈলীর মধ্যে ধরা থাকে ঐতিহাসিকের একান্ত নিজস্ব আক্ষেপ, ‘আমরা নিজেদের নৈতিক স্খলন দিয়েই তাঁকে মেরে ফেলেছি’ (মীরাবেন-এর উদ্ধৃতি), কিংবা ‘Gandhi is a great man but is too great for India and has therefore brought India to grief’ (আসফ আলি-র উক্তি)। এই গভীর আক্ষেপকে এতটুকুও না লুকোনোর চেষ্টা করে মুশিরুল হাসান গাঁধীজি নামক মানুষটির সংকটকে ছোঁওয়ার চেষ্টা করেন মুক্তির আদর্শ, বিশ্বাসের রাজনীতি আর সঙ্গীবৃত্তের দোলাচলের অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে। |
|
|
|
|
|