নাটক সমালোচনা...
মুক্তসঙ্গীত
গাওস্কর নন, গেইল। ধ্রুপদী ড্রাইভ নয়, রিভার্স সুইপ। অফ কিংবা লেগ স্পিন নয়, দুসরা, এমনকী নাক্ল!
আগাগোড়াই এমন খেলা ভাঙার খেলাই যেন ‘ব্রাত্যজন’-এর নতুন নাটক ‘সিনেমার মতো’।
তার সঙ্গে একই মানুযের দুই অবতারের সংঘর্ষ-নির্মাণ-বিনির্মাণের মেগা শো-ও।
তিনি ব্রাত্য বসু। একাধারে নাট্যকার, আবার নাটকটির অন্যতম অভিনেতাও।
কখনও নাট্যকার ছাপিয়েছেন অভিনেতাকে, কখনও উলটোটা। কখনও আবার সমানে-সমানে।
থিয়েটারকে বিষয় করে সিনেমা, বহু না হলেও, হয়েছে। সে ঋত্বিক ঘটকের ‘কোমল গান্ধার’ই হোক, কী ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর ‘লাস্ট মেট্রো’। কিন্তু সিনেমার কয়েক দশকের বিবর্তনকে নিয়ে থিয়েটার? সম্ভবত এই প্রথম। ভারতীয় সিনেমার শতবর্ষ উদ্‌যাপনের বছরে।
এক নতুন ব্রাত্য বসুকে চেনাল ‘সিনেমার মতো’। ‘ক্যায়ামত সে ক্যায়ামত তক’ যুগ থেকে ‘থ্রি ইডিয়টস’ কী ‘তারে জমিন পার’-এর আমির খানের ফারাক যতটা, ততটা হয়তো নয়, কিন্তু ভাঙচুর ব্যাপক।
এই ব্রাত্য ‘অশালীন’, ‘অরণ্যদেব’ কী ‘শহরইয়ার’ বা ‘ভয়’-এর কথাকার তো ননই, এমনকী ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’, ‘১৭ই জুলাই’-এর মতো নাটকেরও লেখক নন। নিজের একুশতম নাটকের মঞ্চায়নে ব্রাত্য তাঁর বিশ্বাস, অবিশ্বাসে এক বারের জন্যও ভেসে যান না, নিজের দার্শনিক বোঝাপড়া দিয়ে ঘটনার পরম্পরা ব্যাখ্যা করেন না, আরোপিত সংলাপে দর্শককে এক শতাংশও ভাষণ দেন না। বরং কাহিনির সূত্র আহরণ করেন নতজানু হয়ে। তাকে বইতে দেন নিজের মতো করে। গবেষকের শ্রম দিয়ে। অনেকটা তাঁর ‘রুদ্ধসংগীত’-এর মতো।
পরদায় ছায়াছবির মতো কাস্টিং দেখানো, দৃশ্যান্তরে যাওয়ার সময় গানের বা ফিল্মি শটের ব্যবহারে এক একটা সময়কে পেরিয়ে চলার ভঙ্গি, এতটাই সূক্ষ্ম, অনুভূতিপ্রবণ, বুদ্ধিদীপ্ত, সুপ্রযুক্ত ব্যঙ্গরসে ভরা, নির্দেশক ব্রাত্যকে কুর্নিশ না জানিয়ে উপায় নেই। সত্তর দশকের ‘মিস ক্যালকাটা’ জয়ন্তী ভদ্র (অনসূয়া মজুমদার)। এখন প্রৌঢ়া অভিনেত্রী। তাঁর বসার ঘরটিতেই এ নাটকের যত ভাঙা, গড়া, ওঠা, পড়া।
নাটকের এক দিকে বইতে থাকে বাংলা সিনেমার চার দশক। মেগা সিরিয়ালের উত্থান। তার দাপট। দুইয়ের দ্বন্দ্ব, অন্তর্দ্বন্দ্ব। অন্য দিকে আভিজাত্য, দম্ভ, গড় মেধা, মধ্য মেধা, আঁকড়ে ধরা বিশ্বাস, টিকে থাকার ইচ্ছে, এগোতে চাওয়া স্বপ্নের ধাক্কাধাক্কি। আবার বিপরীত দুই ধারার মিলমিশও। অসম্ভব পরিণত একটি স্ক্রিপ্ট, নিখুঁত মঞ্চভাবনা (আজহার আলম)। সব মিলিয়ে টানটান উপস্থাপনা।
কলকাতার তরুণ উদ্যোগী ব্যবসায়ী জয়জিত্‌ দত্তগুপ্তর প্রাক্তন স্ত্রী জয়ন্তী। অনিয়ন্ত্রিত দিনযাপনের খেসারত দিয়ে জয়জিত্‌ মারা যান। রেখে যান দেনার পাহাড় আর দুই সন্তান অভিজিত্‌ (ব্রাত্য বসু) ও পৃথ্বীজিত্‌ (কৃষ্ণেন্দু দেওয়ানজি)। দেনা শোধ করতে বাড়ি বিক্রি করতে হয় জয়ন্তীকে। কিন্তু অভিনয়টা চালিয়ে যান তিনি। বিয়ে করেন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক দীপায়নকে (পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়)। তত দিনে অভিজিত্‌ এক জন বার-সিঙ্গারকে বিয়ে করে মুম্বইয়ে।
সমান্তরাল ধারার বাংলা ছবির কট্টর সমর্থক দীপায়ন। জয়ন্তীর অভিনয় জীবনকে কেন্দ্র করে বাংলা ছবির চার দশকের বিবর্তন নিয়ে তিনি তথ্যচিত্র তৈরি করছেন। পৃথ্বী মেগা সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট রাইটার। তাঁর স্বপ্ন আধুনিক বাংলা ছবি তৈরি। পৃথ্বীর বান্ধবী মৈত্রেয়ী (পৌলমী বসু) সিরিয়াল অভিনেত্রী। এঁদের মধ্যে প্রায় উড়ে এসে জুড়ে বসেন অভিজিত্‌। শুরু হয় সর্পিল এক কাহিনি। কোথাও কোনও সরল রেখা নেই, তবু চলাটায় আশ্চর্য এক ভারসাম্য। চরিত্রের কোনওটার প্রতি নাট্যকারের প্রত্যক্ষ আনুগত্য নেই, কিন্তু নৈর্ব্যক্তিক বলাটায় রয়েছে যুক্তি-পালটা যুক্তির নানা স্তর।
ব্রাত্যর দাপানো অভিনয়ও এ নাটকের অন্যতম স্তম্ভ। এ পর্যন্ত মঞ্চে নিঃসন্দেহে এটিই তাঁর সেরা অভিনয়। পাল্লা দিয়ে নিপুণ দক্ষতায় চরিত্র গেঁথেছেন অনসূয়া। নিজেকে ছাপানোর চেষ্টায় পীযূষও। তুলনায় একটু স্তিমিত কৃষ্ণেন্দু বা পৌলমী। তবে মঞ্চস্থ হওয়ার গোড়ার পর্বে এটুকু মেনেই নেওয়া যায়। থিয়েটারের অভিধানে ‘ফাইনাল টেক’ বলে যে কিছু নেই! প্রতি মুহূর্তে, প্রতি দিন এখানে একটা রসায়ন চলে অর্জনের, উপলব্ধির, অনুভবের।‘সিনেমার মতো’, সিনেমা তো নয়!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.