পরপর ইস্তফা বোর্ড সচিব, কোষাধ্যক্ষের
নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনকে ঘিরে মহানাটক কার্যত শেষ রাউন্ডে পৌঁছে গেল। বোর্ড প্রেসিডেন্টকে এমনি সরানো যাবে না বুঝে এ বার তাঁকে কার্যত চার দিক থেকে অবরুদ্ধ করে ফেলতে শুরু করে দিলেন বোর্ডের বিদ্রোহীরা। শুক্রবার রাতে বোর্ডর দুই মহাকর্তা সঞ্জয় জাগদালে এবং অজয় শিরকে নিজেদের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দিলেন। যথাক্রমে বোর্ড সচিব এবং কোষাধ্যক্ষ স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, ভারতীয় ক্রিকেটে যা চলছে, তার পর তাঁদের পক্ষে আর গদি আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব নয়। শ্রীনিবাসনের অবস্থা অনেকটা এখন ডুবন্ত জাহাজের ক্যাপ্টেনের মতো। যে জাহাজের চার দিক থেকে জল ঢুকতে শুরু করেছে। যেখানে একে একে ছেড়ে চলে যাচ্ছে সবাই। তাঁকে একা ফেলে!
রাতে আবার জোর জল্পনা চালু হয়ে গেল যে, পাঁচ জন ভাইস প্রেসিডেন্টও ইস্তফা দিতে চলেছেন। স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। বোর্ডের অন্যতম ভাইস প্রেসিডেন্ট চিত্রক মিত্র ভাইস প্রেসিডেন্টদের ইস্তফার ব্যাপার সম্পূর্ণ অস্বীকার করলেন। বলে দিলেন, এ ব্যাপারে কেউ তাঁর সঙ্গে কোনও রকম যোগাযোগ করেনি। তাই জানেন না। কিন্তু অতীতে আইসিসি-র মহাকর্তা এবং বর্তমানে সিএবি প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়া আবার আনন্দবাজারকে রাতে বললেন, “শ্রীনিবাসনকে যদি চলে যেতে হয়, তাতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ওঁকে সরালেই কি সব সমস্যা মিটবে? আমার মতে তো আইপিএল এক বছর স্থগিত রাখা উচিত।”
ভারতীয় ক্রিকেটের আশি বছরের ইতিহাসে এ রকম কোনও দিন ঘটেনি যেখানে প্রায় পিঠোপিঠি সময়ে বোর্ড সচিব এবং কোষাধ্যক্ষ ইস্তফাপত্র দিয়ে প্রেসিডেন্টকে চাপে ফেলে দিচ্ছেন। সে দিক থেকে ভারতীয় ক্রিকেট এখন তার বৃহত্তম প্রশাসনিক সঙ্কটের মুখে। এমন নজিরবিহীন বিদ্রোহ যে আসতে পারে, সেটা ভাবতে পারেননি শ্রীনিবাসন। বিশেষ করে সঞ্জয় জাগদালে যাঁকে কি না বোর্ড প্রেসিডেন্টের একান্ত অনুগত বলা হত। সচিব সম্পর্কে বোর্ড কর্তাদের কেউ কেউ বলাবলি করতেন, “ওঁর উচ্চতা যতটা, সাহস ঠিক ততটাই কম।” বলা হত, জাগদালে চেন্নাইয়ে গিয়ে শ্রীনিবাসন যা যা ধরাতেন, সব কিছুতে চোখ বুজে সই করে আসতেন।
প্রবল চাপে এখনও অনড় বোর্ড প্রেসিডেন্ট।
সেই জাগদালেই এ দিন রাতে ইস্তফা দিয়ে একটি টিভি চ্যানেলে বলে দিলেন, “শ্রীনিবাসনের বিরুদ্ধে আমার কোনও অভিযোগ নেই। উনি কী করবেন, সেটা সম্পূর্ণ ওঁর ব্যাপার। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটে যা চলছে, তাতে আমি প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছি। সচিব পদ থেকে তাই আমি সরে দাঁড়ালাম। গুরুনাথ কাণ্ডের তদন্তের জন্য বোর্ডের পক্ষ থেকে যে তিন সদস্যের কমিশন তৈরি হয়েছে, সেখানেও আমি থাকছি না। এ বার নতুন মুখ-রা আসুক। দায়িত্ব সামলাক।” তার একটু আগে শিরকে-কে বলতে শোনা গিয়েছে, “আমি কেন ইস্তফা দিয়েছি, তার ব্যাখ্যা আজ নয়, অনেক দিন ধরেই দিচ্ছি। নতুন করে আর কিছু বলতে চাই না।” কিন্তু আপনাকে কি থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন বোর্ড প্রেসিডেন্ট? এ বার শিরকে-র জবাব, “না।”
আসলে বিদ্রোহী কর্তারা বুঝে গিয়েছিলেন, শ্রীনি নিজে থেকে কিছুতেই সরবেন না। তাঁকে সরাতে হবে। বিদ্রোহীদের সামনে দু’টো রাস্তা খোলা ছিল শ্রীনি-অপসারণের।
এক) সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করা। যখন বোর্ডের বার্ষিক সাধারণ সভায় শ্রীনিবাসনকে তৃতীয় বার বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে। এবং আসতে হবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে। সেপ্টেম্বরে শ্রীনি যে জিতবেন না, সেটা এত দিনে চিপকের ঘাসও জেনে গিয়েছে।
দুই) গতানুগতিক ভাবে ইমার্জেন্ট ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক, শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির বৈঠক ডেকে শ্রীনি নিয়ে চরম সিদ্ধান্তে পৌঁছনো। কিন্তু হিসেব করে দেখা যায়, তাতেও সময় লাগবে দেড় মাস। শ্রীনিকে বহিষ্কার করতে করতে জুলাইয়ের মাঝামাঝি হয়ে যাবে।
এই সময়টা বর্তমান পরিস্থিতিতে খরচ করা অসম্ভব বলে মনে করছিলেন কর্তারা। চরম সঙ্কটেও ছ’টা থেকে সাতটা ভোট ছিল শ্রীনির পক্ষে। ওড়িশা, ত্রিপুরা, তামিলনাড়ু, এবং শ্রীনির নিজের ভোট বোর্ড প্রেসিডেন্টের ভোটবাক্সে নিশ্চিত তো ছিলই, সঙ্গে শোনা যাচ্ছিল ঝাড়খণ্ডও শ্রীনির দিকে। সিএবি-ও সুস্পষ্ট ভাবে জানায়নি, তারা কী করবে। যদিও বোর্ডের ভাইস প্রেসিডেন্ট অরুণ জেটলিকে ডালমিয়া জানিয়ে দেন, বিদ্রোহী জোটের মুখ তিনি, অর্থাৎ জেটলি হলে সিএবি সঙ্গে থাকবে। কিন্তু পওয়ার হলে নয়।
হিসেব করে দেখা যাচ্ছিল, ২২ থেকে ২৪টা ভোট থাকছে শ্রীনির বিপক্ষে। কিন্তু তাতেও শ্রীনি-অপসারণে লেগে যাবে দেড় মাস, যে সময়ে ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বনাশ হয়ে যাবে বলে মনে করছিলেন বোর্ড কর্তারা। তখনই ঠিক করে ফেলা হয় তৃতীয় রাস্তার কথা। নিজেরাই ইস্তফাপত্র দিয়ে দাও। দিয়ে চার দিক থেকে অবরুদ্ধ করে ফেলো স্টান্সে অনড় বোর্ড প্রেসিডেন্টকে। জাগদালে ও শিরকের ইস্তফাপত্র সেই তৃতীয় রাস্তা ধরেই। যে প্রসঙ্গে রাতে মিডিয়ার সঙ্গে কোনও কথা বলতে চাননি বোর্ড প্রেসিডেন্ট।
আজকের নাটক অবশ্য শুরু হয়েছিল সন্ধের ঢের আগেই। বস্তুত, এ দিন দুপুর থেকে দু’টো ঘটনা আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটে। প্রথমত, রাজস্থান রয়্যালস পেসার সিদ্ধার্থ ত্রিবেদী দিল্লি কোর্টে স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলে দেন যে, অজিত চান্ডিলারা যে বুকিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, সেটা জানতেন তিনি। চান্ডিলারা ছাড়াও কয়েক জন বিদেশি ক্রিকেটারকেও ত্রিবেদী দেখেছেন ওই বুকিদের সঙ্গে পার্টি করতে। কিন্তু কাছাকাছি সময়ে গুরুনাথ মইয়াপ্পনকে ঘিরে নতুন কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে চলে আসায় ত্রিবেদীর সাক্ষ্য নিয়ে অতটাও আর হইচই হয়নি। আইসিসি-র গোয়েন্দা দফতর নাকি গুরুনাথকে জানিয়েছিল, তাঁর উপর নজর রাখা হয়েছে। মুম্বই পুলিশের জেরায় এই স্বীকারোক্তি করেন গুরুনাথ। কিন্তু তার পরপরই বোর্ডমহলে প্রশ্ন উঠে যায় গুরুনাথকে তো আর আইসিসি নিজে থেকে যোগাযোগ করবে না। নিশ্চয়ই ব্যাপারটা বোর্ডের কোনও কর্তার মাধ্যমেই হয়েছে। এক বোর্ড কর্তা এ দিন আনন্দবাজারকে বলছিলেন, “মুম্বই পুলিশ তো কিছুই বলেনি। আপনারা যা শুনছেন, সেটা কিছুই নয়। আইপিএলে এ রকম ঘটনা অনেক দিন থেকেই ঘটছিল। দ্বিতীয় আইপিএল থেকেই। কিন্তু জগমোহন ডালমিয়াকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকায় কেউ এ দিকটা দেখেনি।” আরও আশঙ্কা, এ সবে এ বার মহেন্দ্র সিংহ ধোনিও জড়িয়ে পড়তে পারেন। শোনা যাচ্ছে, তাঁর এজেন্ট অরুণ পাণ্ডেই নাকি গুরুনাথের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন বিন্দু দারা সিংহের। তা ছাড়া, ভারত অধিনায়কের বিরুদ্ধে ‘কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্টের’ প্রসঙ্গও উঠতে পারে। বলা হতে পারে, একই সঙ্গে কী ভাবে ভারত অধিনায়ক, চেন্নাই সুপার কিংস অধিনায়ক এবং ইন্ডিয়া সিমেন্টসের ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকতে পারেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি?
তবু গোটা দিনের সার্বিক পরিস্থিতি ধরলে, শ্রীনিবাসন আর একা খলনায়ক রইলেন না। ওই একই সরণিতে ঢুকে পড়ল বোর্ড এবং আইসিসি-ও। বলা হচ্ছে, আইসিসি যদি আগেভাগেই সব জানত, তা হলে কিছু করেনি কেন এত দিন? বোর্ডের শেষ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকেও তো আইসিসি-র দুর্নীতি দমন শাখার প্রধান হাজির ছিলেন। কোথায়, তখন তো তিনি কিছু বলেননি? ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থার ভূমিকা নিয়েও তাই রাতে প্রশ্ন উঠে গেল। শ্রীনি-কাণ্ডের পটভূমিতেও যে প্রশ্নকে আরও বড় দেখাচ্ছে।


...যখনই দেখি ক্রিকেট কোনও খারাপ ঘটনার জন্য খবরে আসছে, খুব আঘাত লাগে। গত দু’সপ্তাহে ক্রিকেটে নিত্যনতুন যে সব ঘটনা ঘটছে, তাতে আমি শক্ড। বাগ্রুদ্ধ। প্রচণ্ড হতাশ লাগছে...।
...আমাদের, অর্থাৎ ক্রিকেটারদের সব সময় শেখানো হয় মাঠে গিয়ে নিজেদের সেরাটা দিতে। শেখানো হয়, কঠিন যুদ্ধ করতে। ক্রিকেটের স্পিরিট মেনে খেলতে। যারা দেশের বিভিন্ন মাঠ-ময়দানে খেলে বেড়ায়, যারা ক্লাব, রাজ্য এবং দেশের প্রতিনিধিত্ব করে, ক্রিকেটের এই কঠিন সময়ে আমি সেই সমস্ত ক্রিকেটারের সঙ্গে আছি। আমরা বিশ্বাস করি ক্রিকেটটা যাঁরা চালান, তাঁরা এ সব বন্ধ করতে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন। সমস্যার গভীরে ঢুকে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করবেন...।
...আমাদের উপর কোটি কোটি মানুষ বিশ্বাস রাখেন। সেই বিশ্বাসের মর্যাদা দেওয়া উচিত। আমাদেরই দায়িত্ব তাঁদের বোঝানো যে, ভারতীয় ক্রিকেট মানে গর্ব। ভারতীয় ক্রিকেট মানে অফুরন্ত আনন্দ...।

পুরনো খবর:




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.