চরম কোণঠাসা হয়েও নাছোড় বোর্ড সভাপতি
গুরুনাথ মইয়াপ্পানকে ঘিরে দেশজোড়া নাটকের সপ্তম দিনেও তাঁর শ্বশুরমশাইয়ের চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারণ হল না। নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনকে ঘিরে বুধবারও দিনভর চলল উত্তেজনা, সংশয় আর বিতর্ক। দিনটা শেষ হল এই ভাবেঅ্যাডভান্টেজ শ্রীনিবাসন-বিরোধী গোষ্ঠী। জনমত, মিডিয়া ও সরকার ত্রিমুখী আক্রমণের সামনে পড়ে বোর্ড প্রেসিডেন্টের এখন সরে দাঁড়ানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু পতনের মুহূর্তেও তাঁর মনোভাব হল, যেতে পারি কিন্তু কেন যাব?
ক্রিকেট মহলের একাংশ বুধবার বিকেলে নিশ্চিত ভাবে বলে দিচ্ছিলেন, অদ্য শেষ রজনী। চিঠিটা চলে এল বলে। তাঁদের তীব্র বিশ্বাস ছিল কেন্দ্রীয় সরকারও যখন আদাজল খেয়ে লেগে পড়েছে, তখন কলমডীর রাস্তায় চলে যাওয়া ছাড়া বোর্ড প্রেসিডেন্টের কোনও উপায় নেই। স্বয়ং শ্রীনিবাসন কিন্তু বিকেলেও সংবাদমাধ্যমকে বলে গেলেন, “আপনারা একটু রিল্যাক্স করুন।
আমি মোটেও এখন ইস্তফা দিচ্ছি না।” দুপুরে আইপিএল চেয়ারম্যান রাজীব শুক্ল বিবৃতি দিয়েছিলেন, তদন্তের স্বার্থে শ্রীনিবাসনের সরে থাকা উচিত। সেটাকেই ব্যবহার করে শ্রীনিবাসন বলেন, “আমি তো সরেই আছি। কমিশনের কাজে আমি তো হস্তক্ষেপ করছি না।” তিনি এই বিবৃতি দেওয়ার পর রাজীবের ওপর নিজের দল থেকে তীব্র চাপ সৃষ্টি হয়। তিনি তখন সংবাদমাধ্যমকে পাল্টা জানান, শ্রীনিবাসন বক্তব্য বিকৃত করছেন।
বিকেলের দিকে তখন মনে হচ্ছে, যে কোনও সময় গুডবাই শ্রীনিবাসন। কারণ বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গিয়েছেন একে একে পওয়ার, মনোহর, বিন্দ্রা, আবদুল্লা, জেটলি এবং সিন্ধিয়া। ভারতীয় ক্রিকেটে এই ছ’জন অত্যন্ত প্রভাবশালী। এর সঙ্গে অদ্ভুত ভাবে যোগ দেন মুম্বই ক্রিকেট সংস্থার প্রেসিডেন্ট রবি সাবন্ত। আশ্চর্যের হচ্ছে, সিএসকে-কে ফেয়ার প্লে ট্রফি দেওয়ার মতোই অনেকেরই বিস্ময়কর লেগেছিল, ওয়াংখেড়েকে আইপিএলে সেরা মাঠের পুরস্কার দিয়ে দেওয়া। ধরে নেওয়া হয়েছিল, বাকি যে যা-ই করুক, এমসিএ শ্রীনির পাশে থাকবে। আদতে হল উল্টো। রবি সাবন্ত সরাসরি বলে দিলেন, “শ্রীনিবাসনের জায়গায় আমি থাকলে সরে যেতাম।”
পুলিশের নতুন সন্দেহ-তালিকায় এক সিএসকে ব্যাটসম্যানের নামও তত ক্ষণে জড়িয়ে গিয়েছে, যিনি কি না ওয়ান ডে এবং টি-টোয়েন্টিতে বিখ্যাত। কেউ কেউ মনে করছিলেন, সিএসকে-র ওই ব্যাটসম্যান যদি জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়েন, তা হলে শ্রীনি গভীরতর গাড্ডায় পড়ে যাবেন। বছর দু’য়েক আগেও এই ব্যাটসম্যানটির সঙ্গে এক মহিলার সম্পর্কের কথা কাগজে খুব প্রচার হয়েছিল। পরে জানা গিয়েছিল মহিলাটি বুকি। কাগজে লেখালেখির পরেও ঘটনাটা চেপে দেওয়া হয়। ক্রিকেটারটিও ভারতীয় দলে খেলতে থাকেন। যা সিএসকে প্রতিনিধি না হলে অসম্ভব ছিল।
শুধু তা-ই নয়, ইন্ডিয়া সিমেন্টসের সঙ্গে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির কী আর্থিক লেনদেন ছিল, সেটাও খতিয়ে দেখা হবে। বলা হচ্ছিল, শ্রীনি যত আক্রান্ত হবেন, ধোনির ওপরও তত আক্রমণ আসবে। ধোনির নিরাপত্তাও তত কমবে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির জন্য এরই মধ্যে ইংল্যান্ড পৌঁছে যাওয়া ভারতীয় দল যে এই সব প্রচারে আক্রান্ত বোধ করবে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। এ দিন রাতে ভারতের নানা প্রান্তে বসে থাকা তিন তারকা ক্রিকেটার বলছিলেন, এই বার মজাটা দেখার যে ব্যাকিং কমে গেলে এমএস কী করে? নাম দেওয়া সম্ভব নয়। তবে ধোনির সতীর্থ, এটুকু বললেই হয়তো নামগুলো বেরিয়ে আসে।

ধোনি-শ্রীনি কম্বিনেশনের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনন্ত জল্পনার মাঝে তবু বোর্ড প্রেসিডেন্টের পদত্যাগপত্র জমা পড়ল না। বরং বিসিসিআইয়ের কোনও কোনও কর্তা রাতের দিকে বলতে শুরু করেন, এই মিডিয়া-ট্রায়ালটা অসহ্য পর্যায়ে যাচ্ছে। মিডিয়াই কি বিসিসিআই সংগঠন ঠিক করে দেবে নাকি? তাঁরা পাল্টা হিসেব করে দেখিয়ে দেন, শ্রীনিবাসনকে জবরদস্তি সরানোর জন্য যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দরকার, সেটা আদৌ বিদ্রোহীদের নেই। এঁরা প্রভাবে হেভিওয়েট হতে পারেন, কিন্তু ৩১ ভোটের প্রয়োজনীয় ২৪ ওঁদের হাতে নেই। শ্রীনি সমর্থকদের মনে হচ্ছে, এই যুদ্ধ চলবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। উল্টো দিকে আবার বিরোধীদের বক্তব্য, শ্রীনি-র এত দিনের ভরসার জায়গা দাক্ষিণাত্যেও এ বার ধস নেমেছে। কর্নাটকের কুম্বলে, কেরলের ম্যাথু এবং হায়দরাবাদের বিনোদ তিন জনই আপাতত বিরোধী শিবিরে। সঙ্গে মুম্বইয়ের রবি সাবন্ত। এখনই নাকি শ্রীনির বিরুদ্ধে ভোটসংখ্যা ১৭-১৮। এখন দেখার বিষয় একটা জিনিস, কোনটা আগে হবে? শ্রীনির বিরুদ্ধে ২৪টা ভোট আগে জোগাড় হবে, নাকি বোর্ড প্রেসিডেন্ট নিজে আগে সরবেন?
এর কিছু আগে বোর্ড নির্বাচিত কমিশনে তাঁর তীব্র অনাস্থা পেশ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে পুরো ঘটনা খতিয়ে দেখতে অনুরোধ করেছেন শরদ পওয়ার। পওয়ার বনাম শ্রীনিবাসন এত দিন মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ হচ্ছিল। এ দিন পওয়ার সরাসরি সাংবাদিক সম্মেলনে বলে দেন, “শ্রীনির জায়গায় আমি বোর্ডে থাকলে এ জিনিস ঘটত না। আমরা আমলে অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি তৈরিও হয়নি।” পওয়ার তীব্র আক্রমণ করেন শ্রীনিবাসন নিযুক্ত কমিশনকে। বলেন, “এরা কী তদন্ত করবে? এটা তো ফৌজদারি মামলার পর্যায়ে চলে গিয়েছে। যা দেখছে মুম্বই ও দিল্লি পুলিশ। সেই ফৌজদারি কাজকর্মের তদন্ত কমিশন কী করে চালাবে?” বকলমে পওয়ার বুঝিয়ে দেন, এই আইপিএলে সন্দেহের প্রচুর বীজ আছে। আর সেটা পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য বোর্ড প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত কমিশন কখনও নিরপেক্ষ হতে পারে না। তিনি বলেন, “মনোহর প্রত্যেকটা ম্যাচ নিয়ে তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। আমি তাঁর সঙ্গে একমত।” বিন্দ্রা বলেন, “এই শ্রীনিবাসন লোকটা অত্যন্ত উদ্ধত। ওর এখনই সরে যাওয়া উচিত।”
এই পর্যায়ের আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ ভারতীয় ক্রিকেট-প্রশাসনে ললিত মোদী অপসারণের সময়েও হয়নি। শ্রীনিবাসন সমর্থকেরা বিবৃতি না দিলেও আড়ালে নিজেদের ঘুঁটি গোচ্ছাছিলেন। তাঁরা হিসেব করছিলেন ভোটের অঙ্ক। ওঁদের যুক্তি হল, আবেগ আমাদের বিপক্ষে। অঙ্ক পক্ষে। রাজনীতিবিদরা যতই চিৎকার করুন, শ্রীনি নিজে থেকে পদত্যাগ না করলে কেউ ঘাড়ধাক্কা দিতে পারবে না। তা ছাড়া শ্রীনি তো নিজে কোনও অপরাধ করেননি। তাঁর আমলে বরং বোর্ডের অর্থনৈতিক বাড়বাড়ন্তই হয়েছে। অহেতুক খরচায় তিনি রাশ টেনেছেন। নৈতিক দায়িত্ব ছাড়া শ্রীনি-র ইস্তফা নিয়ে এত চিৎকার করার কী আছে? জনশ্রুতি, শ্রীনির পক্ষে শিবিরের অন্যতম মাথা হলেন জগমোহন ডালমিয়া। ডালমিয়া আনন্দবাজারকে বললেন, “ওঁকে ছাড়তেও বলছি না, থাকতেও বলছি না।” মনে হল তাঁর সমর্থন শ্রীনি-র থাকার পক্ষে। বললেন, “এক জনকে তাড়ানো নিয়ে এত হইচই করে কি ক্রিকেটকে কলঙ্কমুক্ত করা যাবে? বরং এই ক’দিন এটা নিয়ে হইচই করতে গিয়ে আসল সুযোগটা আমরা হাতছাড়া করলাম।”
ভারতীয় ক্রিকেটের এই অভূতপূর্ব টালমাটাল পরিস্থিতিতে আপনি কোন দিকে? ডালমিয়ার উত্তর, “এখনও কোনও দিকে নেই। দু’এক দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেব।” ডালমিয়া আবার বললেন, “আসল ইস্যুগুলো আমরা হারিয়ে ফেললাম। আইপিএলে চিয়ারগার্ল থাকা উচিত কি উচিত নয়, তা নিয়ে কি কেউ ভাবছে? আসলে আমরা সবাই ব্যক্তিকে তাড়ানো নিয়ে পড়ে আছি। যেটা কাঙ্ক্ষিত নয়।” বোঝা গেল সিএবি প্লাস এনসিসি এই দু’টো ভোট এখনও বিরোধীদের দিকে নিশ্চিত নয়। যদিও ডালমিয়া শেষ করলেন ম্লান সুরে, “যদি সবাই চায়, তা হলে যাক।”
যেখানে সবাই যখন তাঁকে বলছে, তদন্তে নিরপেক্ষতা প্রমাণিত হলে আবার তিনি ফিরে আসতে পারবেন, শ্রীনিবাসন সম্মান নিয়ে সরে যাচ্ছেন না কেন? রাতে এই প্রশ্ন শুনে এক বোর্ড সদস্য বললেন, “ওনার এটুকু বোঝার বুদ্ধি আছে, এক বার ছেড়ে দিলে আর জীবনেও উনি বোর্ডে ফিরতে পারবেন না। চেয়ার থাকলে এক রকম ভোট। না থাকলে আর এক রকম। শ্রীনির এখনও এক বছর তিন মাস মেয়াদ বাকি আছে। এটাও মনে রাখবেন, উনি ক্ষমতা খুব ভালবাসেন।”
‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব’ নিয়ে ধোঁয়াশা তাই বুধবার রাতেও জাতীয় হেডলাইনে থেকে গেল! এমনও শোনা যাচ্ছে, শ্রীনি নাকি ৩১ মে, শুক্রবার সিদ্ধান্ত ঠিক করবেন। মুম্বই হাইকোর্টে সে দিন জামাই গুরুনাথ জামিন পেলে এক রকম। না পেলে আর এক রকম। মানে, শুক্রবার পর্যন্ত জাতীয় হেডলাইনে থেকে যাচ্ছেন নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন।

পুরনো খবর:




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.